মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ও সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহীনুর রহমানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। তাদের দ্বন্দ্বের সুরাহ না হওয়ায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

পাল্টাপাল্টি থানায় লিখিত অভিযোগ আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজ নিজ অনুসারীদের দিয়ে একে-অপরের অপসারণের দাবিসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে হাসপাতালে প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন পালন করাচ্ছেন তারা। এতে জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে। আবার অনেক রোগীর স্বজনরা কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাওয়া নিয়েও চিন্তিত রয়েছে।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ অস্বাভাবিক হওয়ার পেছনে তত্ত্বাবধায়ক সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহীনুর রহমানকেই দায়ী করছেন। অপরদিকে নার্স শাহীনুরের দাবি- হাসপাতালের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তার প্রতি ক্ষীপ্ত হয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও তার অনুসারীরা।

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহীনুর রহমানের নিজ এলাকার সাধারণ জনগণ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ও সিনিয়র স্টাফ নার্স সাইফুল ইসলামের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে হাসপাতাল চত্বরে পুলিশের উপস্থিতিতে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ করার চেষ্টা করে। তবে তত্ত্বাবধায়কের অনুসারী কয়েকজন বহিরাগত ব্যক্তি তাদের উপর চড়াও হয় এবং বিক্ষোভ সমাবেশ করতে বাধা দেয়। এ সময় হাসপাতাল চত্বরে পুলিশের সামনেই বহিরাগতরা শাহীনুরের অনুসারীদের কাছ থেকে ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং গালিগালাজ করে হাসপাতাল চত্বর থেকে বের করে দেয়। 

এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের অনুসারী ও নার্সরা হাসপাতাল চত্বরে শাহীনুরের অপসারণ-শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন। অপরদিকে একই দিনে প্রেসক্লাব চত্বরে নার্স শাহীনুরের এলাকাবাসী তত্ত্বাবধায়কের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৫ মে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের নাম ব্যবহার করে ও নানান অজুহাতে সপ্তাহে চারদিনই হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকতেন। এ ছাড়া হাসপাতালে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করে আসছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জান্নাত আরা শিমুল, সাইফুল ইসলাম, সহকারী নার্স মোতালেব হোসেন ও নার্সিং সুপারভাইজার আনিছুর রহমান। তাদেরকে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের বিশ্বস্ত করে নেন তত্ত্বাবধায়ক।

এদিকে জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জন ভর্তি রোগী চিকিৎসা সেবা নেন। হাসপাতালের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানান চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা।

জেলা শহরের বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছি। তবে হাসপাতাল চত্বরে অনেক লোকজনের সমাগম দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে যাই। জানতে পারলাম হাসপাতালের দুইজন কর্মকর্তার মধ্যে কি যেন ঝামেলা চলছে। হাসপাতালের পরিবেশ এ রকম অশান্ত হওয়ায় আমরা সাধারণ মানুষ কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত।

সদর উপজেলার বেতিলা গ্রামের রানা মিয়া বলেন, রক্ত পরীক্ষা ও বুকের এক্স-রে করাতে বেলা সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে আসি। হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে অনেক লোকজন আর পুলিশের গাড়ি দেখে চিন্তায় পড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর দেখি কিছু লোকজনের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি দেখে কিছুটা ভয়ও পেয়েছি। হাসপাতালের ভেতরে এমন উত্তপ্ত পরিবেশ আমাদের কাম্য নয়। তাদের মধ্যে গোন্ডগোলের কারণে আমরা সঠিকভাবে চিকিৎসা পাব কি না তা নিয়ে চিন্তিত।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে দেখতে আসা আল-আমিন বলেন, দুইদিন ধরে আমার এক আত্মীয় ভর্তি, তাকে দেখতেই হাসপাতালে এসেছি। তবে গেট দিয়ে আসার সময় অনেক লোকজন দেখে মনে হলো গোন্ডগোল হচ্ছে। পরে আত্মীয়র কাছ থেকে শুনলাম, হাসপাতালের বড় স্যার আর নার্সদের মধ্যে নাকি ঝামেলা হইছে।  

এ বিষয়ে হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহীনুর রহমান বলেন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের ছত্রছায়ায় কথিপয় নার্স অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তারা আমার ওপর ক্ষীপ্ত। গত ২০ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক স্যার আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিকভাবে হেনস্থা করেন। তার অনুসারীদের দিয়ে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেন। পরে জীবনের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে ওই দিনই সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। আজকে আচরণবিধি ও শৃঙ্খলাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও করেছি। তবে হাসপাতালের পরিবেশ উত্তপ্ত করার পেছেনে তত্ত্বাবধায়ক ও তার অনুসারীরাই দায়ী। 

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, নার্স শাহীনুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি এবং শৃঙ্খলাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে শাহীনের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং  নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর বরাবর আলাদা দুটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। 

হাসপাতাল চত্বরে বহিরাগতদের দিয়ে বিক্ষোভে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, আজকে কে বা কারা বিক্ষোভে বাধা দিয়েছে তা আমার জানা নেই এবং তারা বহিরাগত কিনা তাও বলতে পারব না। 
উভয়ের দ্বন্দ্বের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাহীনের সাথে আমার দ্বন্দ্বে জাড়ানোর প্রশ্নই আসে না। তিনি উল্টো এই প্রতিবেদকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আপনি কি আপনার সম্পাদকের সাথে অসভ্য আচরণ করতে পারেন? আপনার সম্পাদকের বিরুদ্ধে গিয়ে আপনি কি করতে পারেন? এই জবাবটা আপনি আগে দেন।

তিনি বলেন, আজকে হাসপাতাল চত্বরে শাহীনুরের লোকজন জমায়েত হওয়ার বিষয়টি জানার পর পুলিশকে অবহিত করি। আপনারা যেমন জেনেছেন, আমিও ওইভাবেই জেনেছি। আজকে আপনিও তো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে এমন পরিস্থিতি দেখেন, তাহলে আপনিও বিস্মিত হবেন। তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে যারাই এখানে চিকিৎসা নিতে এসে এমন পরিস্থিতি দেখলে তারাও বিস্মিত হবে এবং ভয় পাবে। 

তত্ত্বাবধায়ক আরও বলেন, আমি তো ওর (শাহীন) কাজে বাধা দিচ্ছি না, তাহলে ও (শাহীন) কেন হাসপাতালের পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলছে। কেন ওই দিন প্রেসক্লাবের সামনে আমার বিরুদ্ধে ওর লোকজন দিয়ে মানববন্ধন করালো। শাহীন স্পষ্ট সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে অন্যায় করেছে, তার বিরুদ্ধে একটা অ্যাকশন নিয়েছি বলেন। আমার ক্ষমতার অপব্যাহার করেছি এমন একটা উদাহারণ দেখাতে পারবেন না।

এ বিষয়ে সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাবিল হোসেন বলেন, জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও নার্স উভয়ই থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ দুটি তদন্তাধীন রয়েছে। 

সোহেল হোসেন/আরএআর