বরগুনার আমতলী পৌরসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামী ৯ মার্চ। টানা ১৩ বছর এই পৌরসভায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও মো. মতিয়ার রহমান কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাস্তবায়নে ব্যর্থ বলে দাবি করেছেন পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হতে চান তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।

আমতলী পৌরসভা ১৯৯৮ সালে গঠিত হওয়ার পর সর্বশেষ ২০১১ সাল থেকে প্রায় ১৩ বছর ধরে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন মো. মতিয়ার রহমান। এই দীর্ঘ মেয়াদে আইনি জটিলতায় নির্বাচন স্থগিত হয়ে প্রথম মেয়াদে ৭ বছর এবং দ্বিতীয় মেয়াদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আরও ৫ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই দীর্ঘ মেয়াদে মতিয়ার রহমান মেয়রের দায়িত্ব পালন করলেও পৌরবাসীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারায় পৌরসভা নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও আটজন প্রার্থী। 

পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবে শুকনো মৌসুমেও অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভায় এখনও অনেক জায়গার বাসিন্দাদের চলাচল করতে হয় সাঁকো দিয়ে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও কোনো উন্নতি নেই। পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির অভাবে নোংরা পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। সড়কের অভাবে বর্ষা মৌসুমে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানির মধ্য দিয়ে চলাচল করতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। 

আমতলী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পৌরসভা প্রথম শ্রেণির হলেও বাংলাদেশের আর কোথাও এখানকার মতো রাস্তাঘাটের এতো খারাপ অবস্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। 

আলমগীর হোসেন নামে আরেকজন বাসিন্দা বলেন, কাদা পানি পাড় হয়ে আমাদের যাতায়াত করতে হয়। বর্ষা মৌসুমে ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে হয়। আমরা কোনো সরকার চিনি না, কোনো প্রার্থী চিনি না। আমাদের উন্নয়নে যে কাজ করবে এবার আমরা এমন প্রার্থীকেই ভোট দেব।

দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বাঁশের সাঁকো পাড় হয়ে বাড়ি থেকে রাস্তায় উঠতে হয় শাহানাজ বেগমসহ তার আশপাশের আরও অনেককে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাঁকো পাড় হয়ে আমাদের যাতায়াত করতে হয়। এমনকি বৃষ্টির সময়ে পানিতে তলিয়ে থাকে সাঁকো। বাচ্চারা অনেক সময় পাড় হতে গিয়ে পড়ে যায়। আমরা ১২ বছর ধরে এই সাঁকো দিয়ে চলাল করি। 

আমতলী ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বাঞ্চল এলাকা সব থেকে বেশি অবহেলিত। এখানে রাস্তা, বিদ্যুৎ, পৌরসভার পানি কিছুই নেই। বৃষ্টি হলে এলাকায় পানি জমে যায়, গলা সমান পানি পাড় হয়ে পাকা রাস্তায় উঠতে হয়। এ সময় আমরা কাজের তাগিদে বের হলেও নারীরা ঘর থকে বের হতে পারে না। বিশেষ করে তখন শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

আনোয়ার হাওলাদার পেশায় একজন অটোরিকশা চালক। দীর্ঘদিন ধরে অটোরিকশা চালান আমতলী পৌরসভায়। বিভিন্ন রাস্তার বেহাল অবস্থা জানিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু কিছু রাস্তা ভালো থাকলেও অধিকাংশ রাস্তাই ভাঙা। এসব রাস্তায় গাড়ি চালালে একেতো শরীরের অবস্থা খারাপ হয়। অপরদিকে গাড়িরও বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি হয়। 

আমতলী পৌরসভার বর্তমান মেয়র মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে হ্যাঙ্গার প্রতীকের মেয়র প্রার্থী নাজমুল আহসান খান নান্নু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৫ সালের পর পৌরসভায় আর কোনো নির্বাচন হয়নি। বর্তমান মেয়র মতিয়ার রহমান কৌশলে গত ১৩ বছরে নির্বাচন করতে দেননি। প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভায় জলবায়ু প্রকল্পসহ সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে আমতলী পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে এ টাকায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে বিভিন্ন গ্রামের থেকেও এ পৌরসভার অবস্থা খারাপ। 

তিনি আরও বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে আমি মেয়র ছিলাম। এছাড়াও দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার বাবাও চেয়ারম্যান ছিলেন। এ কারণে আমরা পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরেছি। দীর্ঘ ১৩ বছরে এখানে কোনো কাজই হয়নি। মতিয়ার রহমান দুর্নীতির মাধ্যমে শুধু নিজে টাকার পাহাড় তৈরি করেছেন। এছাড়াও উন্নয়নের নামে রাস্তা ভেঙে রেখে কাজ না করে বিল উঠিয়ে নিয়েছেন তিনি। পৌরসভায় উন্নয়ন ধরলে শুধু তার বাসার উন্নয়ন হয়েছে। কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে তিনি আমতলীতে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এছাড়া ওই বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি দখল করেছেন ২ একর সরকারি জমি। এছাড়াও পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জমি দখল করে একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন তিনি। এলাকয় কোনো কাজ না করে দুর্নীতির মাধ্যমে মেয়র মতিয়ার রহমান এসব করেছেন। 

এ বিষয়ে আমতলী পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত কিছু কিছু উন্নয়ন করতে পারেননি স্বীকার করে বর্তমান মেয়র ও মোবাইল প্রতীকের প্রার্থী মতিয়ার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌরসভার সার্বিক উন্নয়ন আমি কাজ করেছি। বিভিন্ন ওয়ার্ডের সংযোগ সড়কের কাজ এমনভাবে করেছি তাতে সকল ওয়ার্ডেই অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও যেতে পারবে। তবে ইচ্ছে করলেই উন্নয়ন করা যায় না, অনেক কষ্ট, ত্যাগ, মানুষের পেছনে ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার পেছনে ঘুরে উন্নয়ন কাজ করতে হয়। 

তিনি আরও বলেন, পৌরসভার প্রধান প্রধান সড়কের কাজ আমি করেছি। শুধুমাত্র বাড়িঘরের ছোট ছোট রাস্তার সংযোগ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ কিছু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের কাজ করতে পারিনি। আর এসব অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতেই এখন নির্বাচনে আবারও জনগণের কাছে ভোট চাচ্ছি। এছাড়া জনগণ বিশ্বাস করে আমি যে কাজ ১ বছরে করতে পারব তা অন্য কেউ ১০ বছরেও করতে পারবে না। 

বর্তমান মেয়র হিসেবে দীর্ঘ ১৩ বছরে কি কি উন্নয়ন করেছেন- জানতে চাইলে মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, উপজেলা পর্যায়ে এতো বড় পৌরসভায় আমি যে কাজ করেছি তা আর দশটা পৌরসভার তুলনায় বেশি। আমি মেয়র নির্বাচিত হয়ে সাইক্লোন শেল্টার, ঘাটলা, প্রশস্থ রাস্তা, দুই কিলোমিটারের বঙ্গবন্ধু সড়ক, গরুর বাজার, কাঠ বাজার ও মাছ বাজারের সৌন্দর্যবর্ধন করেছি। এছাড়াও এলাকার মা-বোনদের ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণসহ শিশুবান্ধব ও নতুন প্রজন্মের জন্য কাজ করেছি। পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে কাজ করেছি।

 প্রসঙ্গত, আমতলী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে ৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরা হলেন-  মোবাইল ফোন প্রতীকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র মো. মতিয়ার রহমান, হ্যাঙ্গার প্রতীকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক মেয়র মো. নাজমুল আহসান নান্নু, নারিকেল গাছ প্রতীকে জিল্লুর রহমান, বড়শি প্রতীকেনুসরাত জাহান, ক্যারাম বোর্ড প্রতীকে জহিরুল ইসলাম খোকন , চামচ প্রতীকে ইফতেখার হাসান, কম্পিউটার প্রতীকে আব্দুল্লাহ আল মামুন,  জগ প্রতীকে আবুল কালাম আজাদ ও লন্ড্রি প্রতীকে কামাল হোসেন। এছাড়াও কাউন্সিলর পদে ৩৭ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর