বাবার কোলে শিশু আয়ান

পদ্মা নদী বেষ্টিত প্রত্যন্ত চরাঞ্চল কাঁচিকাটা। দুর্গম এলাকা হওয়ায় যে কোনো সমস্যায় এখানকার শিশু-বৃদ্ধসহ অধিকাংশ মানুষই সঠিক চিকিৎসা সেবা পায় না। এমনই এক শিশু ছিল আবরার মাহতাব আয়ান। নিশ্চিত বাকপ্রতিবন্ধী হতে চলছিল সে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে জ্বর-ঠান্ডার চিকিৎসা নিতে এসে কথা বলার উপায় খুঁজে পেয়েছে সে। চিকিৎসার পর এখন সে সকল শব্দই শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে কথা বলতে পারে। এতে উচ্ছ্বসিত আয়ানের পরিবার ও স্বজনরা।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন আয়ান ও তার পরিবারের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসা সেবার কারণেই আয়ান এখন কথা বলতে পারে।

জানা যায়, গত বছরের ২৪ জুন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার দুর্গম চরাঞ্চল কাঁচিকাটা ইউনিয়নের কাঁচিকাটা মডেল হাই স্কুল মাঠে দিনব্যাপী ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে। ওই সময় জ্বর ও ঠান্ডায় ভুগছিল চার বছরের বাকপ্রতিবন্ধী শিশু আবরার মাহতাব আয়ান। জ্বর-ঠান্ডার চিকিৎসার জন্য তাকে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে আসেন তার বাবা পলাশ হাওলাদার ও চাচি তহুরা বেগম। মেডিকেল ক্যাম্পের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আয়ানকে দেখছিলেন। এ সময় আয়ানকে স্বাভাবিক রাখতে একটি চকলেট উপহার দেওয়া হলে আয়ান চকলেটটি মুখে দিতে গেলে চিকিৎসক খেয়াল করেন আয়ান বাকপ্রতিবন্ধী হতে চলছে।

চিকিৎসক আয়ানের চাচিকে জিজ্ঞেস করেন আয়ান কথা বলতে পারে কিনা? তিনি চিকিৎসককে জানিয়েছিলেন- ‘ফিডার খাওয়ার কারণে মিহি করে তোঁতলিয়ে কথা বলতে পারে আয়ান। ফকির বলেছে, বড় হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এমন উত্তর শুনে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আয়ান আর একটু বড় হলেই পুরোপুরি বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে যাবে। এমন কথা জেনে আয়ানের বাবা ও চাচি চিন্তায় পড়ে যান। মেডিকেল ক্যাম্পে এমন ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে পুরো ক্যাম্প ও কাঁচিকাটা জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তবে চিকিৎসক আশ্বাস দেন, আয়ানের জিহ্বার ছোট একটি রগ অপারেশন করলে সে স্বাভাবিক শিশুর মতো কথা বলতে পারবে।

এ ঘটনা নিয়ে ঘটনার দিনই ‘মা-বাবা জানতেন না বাকপ্রতিবন্ধী হতে চলেছে শিশু আয়ান’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট। 

এরপর আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর চিকিৎসক ডা. আবজালুল বাশারের পরামর্শ অনুযায়ী গত বছরের আগস্ট মাসে ঢাকার শিশু হাসপাতালে শিশু আবরার মাহতাব আয়ানের অপারেশন করা হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে আয়ান বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পর সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক শিশুর মতো কথা বলা শুরু করে। এখন সে তার বয়সী অন্য শিশুদের মতো সকল শব্দই উচ্চারণ করে কথা বলতে পারে। আয়ান কথা বলতে পারায় উচ্ছ্বসিত তার পরিবার ও স্বজনরা।

আয়ানের চাচি তহুরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের সময় আয়ানের মা ও আয়ান দুইজনেই অসুস্থ ছিল। জ্বর-ঠান্ডা না লাগলে তাকে মেডিকেল ক্যাম্পে নেওয়া হতো না। জ্বর-ঠান্ডা ও মেডিকেল ক্যাম্পের কারণেই আয়ান এখন কথা বলতে পারে। আনসার বাহিনীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

আয়ানের কথা বলা নিয়ে তার মা সুলতানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন আয়ানের সমস্যা ধরা পড়ে, তখন আমি ভীষণ অসুস্থ। যাদের উছিলায় আমার ছেলে কথা বলতে পারছে, তাদেরকে এখনও দুই চোখে দেখি নাই আমি। ওই ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের সাথে জড়িত সকলের জন্য আমি প্রতিদিন দোয়া করি। আমার ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।

আয়ানের বাবা পলাশ হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে আয়ান আমাকে বলেছিল ‘বাবা আমি চকলেট খাব’। তার মুখে স্পষ্ট এমন কথা শোনার পর আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি। আনাসার বাহিনী কাঁচিকাটায় ফ্রি মেডিকেল না করলে আমরা জানতাম না যে আয়ানের মুখে সমস্যা, বড় হলে সে বাকপ্রতিবন্ধী হবে। কারণ দুর্গম নদী পথ পাড়ি দিয়ে শিশু আয়ানকে নিয়ে কখনো শহরের ডাক্তারের কাছে যাওয়া হত না আমার। যাদের উছিলায় আমার ছেলে কথা বলতে পারছে, তাদের জন্য দোয়া করি, তারা যেন এমন ভালো কাজ আরও করতে পারেন।

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী হাসপাতাল গাজীপুরের জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) ও আয়ানের প্রাথমিক চিকিৎসক ডা. আবজালুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেলের ভাষায় ডাঙটাই নামে পরিচিত একটি সমস্যা আয়ানের জন্মগতভাবেই ছিল। জ্বর-ঠান্ডা নিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পে আসার পর তার এই সমস্যা আমার চোখে পড়লে তার পরিবারকে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছিলাম। চিকিৎসার পর আয়ান এখন কথা বলতে পারে এটা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। প্রত্যেক শিশুর মা-বাবার উচিত এসব বিষয় খেয়াল রাখা। আয়ানের কথা বলতে পারা আমার চিকিৎসক জীবনের একটি উপহার।

শরীয়তপুরের আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জেলা কমান্ড্যান্ট মো. মইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায় সময়ই দুর্গম এলাকায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়। কাঁচিকাটায় মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা করার সময় আয়ান নামে এক শিশুর জন্মগত একটি সমস্যা চিহ্নিত হয়েছিল। সেই শিশু এখন কথা বলতে পারে, এটা অনেক বেশি আনন্দের খবর। কেননা, একজন মানুষের জীবনে অন্যতম নেয়ামত হলো কথা বলতে পারা। আয়ানের জন্য দোয়া করি, সে বড় হয়ে তার মুখের কথা দ্বারা মানুষের কল্যাণে যেন কাজ করতে পারে।

সাইফ রুদাদ/আরএআর