দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে ক্ষমতাসীন দলটির কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগ দলকে সংগঠিত করাসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সফলতা অর্জন করে। এবারের নির্বাচনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি (জাপা) মাত্র ১১টি আসন পেয়ে সংসদের বিরোধী দল মনোনীত হয়।

তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপি, ইসলামী আন্দোলনসহ তাদের মিত্ররা নির্বাচন বয়কট করে। বর্তমানে তারা সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। যদিও তাদের আন্দোলনে গতি নেই।

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নির্বাচনে হতাশাজনক ফলাফলের পর দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। দেবর-ভাবির বিরোধে দলের মধ্যে বিভক্তিও তৈরি হয়েছে। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ আগামী ৯ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশন ডেকেছেন। সেই কাউন্সিলে থাকছেন না রওশনপন্থ ‍ু হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গাঁসহ রংপুর বিভাগের শীর্ষ কয়েকজন নেতা।

এদিকে রংপুরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রধান তিন দলেরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে তা জানেন না নেতারা। দলের গতিশীলতা বাড়াতে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দাবি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের। তারা বলছেন, সম্মেলন বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে দলীয় কার্যক্রমে আরও গতি ফিরবে।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। তিনি বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে জামানত হারান। নির্বাচনে জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আমিরুজ্জামান পিয়াল। ওই নির্বাচনের পর থেকে রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।

এর প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি কেন্দ্র থেকে রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপরেই রংপুর মহানগর শাখায় ডা. দেলোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল কাশেমকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং  রংপুর জেলা শাখায় একেএম ছায়াদত হোসেন বকুলকে আহ্বায়ক ও অধ্যাপক মাজেদ আলী বাবুলকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। এরপর ১১ই ফেব্রুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে দলের নেতাদের অনেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবি তুলেছেন নেতাকর্মীরা।

অন্যদিকে রংপুরকে নিজেদের দুর্গ দাবি করা জাতীয় পার্টির জেলা কমিটি চলছে আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে। মহানগর জাতীয় পার্টির পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকলেও জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। জানা যায়, রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ছিলেন জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব ও সাবেক চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। ২০২২ সালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে ওই বছর ২০ সেপ্টেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মাসুদ চৌধুরী নান্টুকে আহ্বায়ক ও আব্দুর রাজ্জাককে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এরই মধ্যে চলতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আবুল মাসুদ চৌধুরী নান্টু। এরপর থেকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, রংপুর মহানগর সভাপতি ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে। তিনিই বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন।

দলটির নেতাকর্মীরা জানান, গত ১০ ফেব্রুয়ারি রংপুরে কর্মীসভায় হঠাৎ দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, মহানগর জাপার সভাপতি ও সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সামনে তিনি বলে বসেন, তিনি আর জাতীয় পার্টির জেলার দায়িত্ব পালন করবেন না। দল থেকে পদত্যাগ করবেন। তার এমন বক্তব্যে সভাস্থলে তুমুল হইচই শুরু হয়। যদিও এ বিষয়ে পরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তবে অনেকেই বলেছেন, এটা ঠিক হয়ে গেছে।

এদিকে ২০২২ সালের এপ্রিলে দীর্ঘ ৫ বছর পর রংপুর জেলা ও মহানগর বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। ঘোষিত জেলা বিএনপির কমিটিতে বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান লাকুকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। ৩৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আফসার আলীকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এ ছাড়া মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সামসুজ্জামান সামুকে আহ্বায়ক ও মহানগর যুবদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন-নবী ডনকে সদস্য সচিব করে ৪২ সদস্য বিশিষ্ট রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। সেই আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে বিএনপির দাবি আদায়ের নানা আন্দোলন।

এর মধ্যে মহানগর কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন-নবী ডন একটি মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। বর্তমানে মহানগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হিসেবে আব্দুস সালাম দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে একই মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে পলাতক রয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু। এ কারণে দলের কার্যক্রমে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক একেএম ছায়াদত হোসেন বকুল বলেন, রংপুরে আওয়ামী লীগ পূর্বের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। যার প্রমাণ মিলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তারপরও দলকে আরও শক্তিশালী করতে এবং সরকারের উন্নয়নের বার্তা মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে দলের নেতাকর্মীরা নিবেদিতভাবে মাঠে রয়েছেন।

এ ব্যাপারে রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব হাজী আব্দুর রাজ্জাক জানান, জাতীয় পার্টির ঘাঁটি রংপুর। এখানে শায়িত আছেন পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তাই এখানে অন্য কোনো দলের স্থান হতে পারে না। তারা দলকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করছেন বলে তিনি জানান।

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, সরকারের মামলা, হয়রানি ও নির্যাতনের পরও রংপুর মহানগর ও জেলায় বিএনপি অত্যন্ত শক্তিশালী। দলের কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া জেলা ও মহানগর বিএনপি একসঙ্গে এবং পৃথকভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফলভাবে পালন করছে। বিএনপির সকল নেতাকর্মী রাজপথে রয়েছে। নেতাকর্মীরা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পালন করছেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর