শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার সারিকালীনগর এলাকার বাসিন্দা সুমন মিয়া। পাসপোর্টের আবেদন সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দালালের বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন তিনি। খুইয়েছেন সাড়ে সাত হাজার টাকা। ঢাকা পোস্টকে সুমন মিয়া বলেন, নিজে আবেদন করতে না পারায় পাসপোর্ট অফিসে এসেছিলাম। এখানে মামুন নামের একজন আমাকে পাসপোর্টের আবেদন করে দেবে বলে পাসপোর্ট অফিসের পাশেই রাহিম ওভারসিজ অফিসে নিয়ে যায়। তারাই আমাকে আবেদন ও ব্যাংকের টাকা জমা দেওয়ার কথা বলে সাড়ে সাত হাজার টাকা নেয়। টাকা জমা ও আবেদনের ১৩ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সেই আবেদন পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এখন পাসপোর্ট অফিসের গেটে গেলেও আনসারদের টাকা দিতে হয়, নাহয় পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতে দেয় না।

একই অবস্থা শেরপুরের কুঠুরিকান্দা এলাকার জীবন হোসেনেরও। গত রোববার (৩ মার্চ) পাসপোর্টের আবেদন করতে এসে তিনিও পড়েন স্থানীয় দালালদের খপ্পরে। শেরপুর পাসপোর্ট অফিসের পাশেই গড়ে ওঠা সৈকত কম্পিউটারের স্থানীয় দালালের কাছে আবেদন ও ব্যাংক জমার জন্য মোট সাত হাজার টাকা দিয়েও মেলেনি ফিঙ্গারপ্রিন্টের অনুমতি। ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো মেসেজ না আসায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন আবেদনে অসঙ্গতি থাকায় ‘হোল্ড’ করে রাখা হয়েছে তার আবেদন। পাসপোর্ট অফিস থেকে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের দোকানের মেইল ব্যবহার করার জন্য আবেদন এখনো আটকে রাখা হয়েছে।

শেরপুরের পাসপোর্ট অফিসের চিত্র খুঁজতে গিয়ে এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। সবারই অভিযোগ বহিরাগত দালাল বা টানা দালালের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেবাগ্রহীতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের স্টাফ যথেষ্ট ভালো আছে। এখানের মূল সমস্যা হলো দালাল। ওই দালালরাই অফিসে কোনো সেবাগ্রহীতা এলে তাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে পাসপোর্ট অফিসের সামনের দোকানগুলোতে নিয়ে যান। ওই দোকানগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আনসারদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির জন্য আনসারদেরও টাকা দিতে হয়। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টের সময় আনসারদের টাকা না দিলে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রাখা হয়। এ ছাড়া ভোগান্তি তো আছেই।

২০১৪ সালে শহরের চকপাঠক এলাকার একটি ভাড়া বাসায় শেরপুর পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম চালু হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ২০২৩ সালের এপ্রিলে শেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পৌর শহরের নবীনগর এলাকায় নতুন ভবনে স্থানান্তরের পর থেকেই কার্যালয়ের সামনে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান। এই দোকানগুলো থেকেই মূলত দালাল সিন্ডিকেট পরিচালনা হয় বলে অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের। স্থানীয় সৈকত ডিজিটাল কম্পিউটার, রানা কম্পিউটার, দি রাহিম ওভারসিজ এবং অ্যালায়েন্স ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের এলাকায় নিজস্ব কমিশন ভিত্তিক প্রতিনিধির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে পাসপোর্টের আবেদনের প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে।

রেজাউল করিম নামের এক সেবাগ্রহীতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি একবারে সীমান্ত এলাকা থেকে এসেছি। নিজে আবেদন করে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছি। কোনো ভোগান্তি ছাড়া আমার ফিঙ্গারপ্রিন্টও দিয়েছি। যারা নিজেরা আবেদন করতে পারে না বা ভুল আবেদন করে তাদের পেছনেই দালাল লেগে যায়। একটা ছোট ভুল সংশোধনের জন্যও দুই/তিন হাজার টাকা নেয় এখানকার দালালরা। তবে এসব দালালের সঙ্গে অফিসের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে হয়নি। এরা হলো সামনের দোকানের প্রতিনিধি।

আনসার সদস্য মো. হৃদয়

এদিকে পাসপোর্টের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে গিয়ে আনসার সদস্যদের দ্বারা ভোগান্তির প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। পাসপোর্ট অফিসের সামনে দায়িত্বে থাকা মো. হৃদয় ও সেলিম নামের আনসার সদস্যকে দিতে হয় ‌‌স্পিড মানি। তাদের দুজনকে টাকা না দিলে সহজে অফিসে ঢোকা যায় না। এই দুজনেরও রয়েছে নির্ধারিত প্রতিনিধি (দালাল)। তাদের মাধ্যমেই এই স্পিড মানির বিষয়টা ম্যানেজ করেন হৃদয় ও সেলিম।

টাকা নিয়ে সুমন মিয়ার পাসপোর্ট না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দি রাহিম ওভারসিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বিপ্লব ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। দালালমুক্ত করার জন্য সরকার আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমাদের প্রতিনিধিরা এলাকায় ঘুরে দালালমুক্ত সেবার বিষয়ে মার্কেটিং করেন। এখন তাদের মাধ্যমে যদি কেউ আমাদের কাছে আসে তাহলে তো আমাদের করার কিছু নেই।

সরকারের ব্যাংক ফি’র চেয়ে বেশি টাকা নেওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমরা এক টাকাও বেশি নিই না। বরং আমাদের কোনো কাস্টমারকে পাসপোর্ট অফিসে পাঠালে আনসারদের টাকা না দিলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে দেওয়া হয় না। আমরাও আনসারদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।

ওভারসিজ ও ট্যুরস ট্রাভেলসের জন্য অনুমোদন আছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোটি টাকা দিয়ে সরকারের অনুমোদন নিয়েছি। সরকারকে টাকা দিয়ে আমরা ব্যবসা চালাই। আমি আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের লাইসেন্সের কপি পাঠাচ্ছি। যদিও পরবর্তী তিন দিনেও তিনি লাইসেন্সের কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে পারেননি। বরং সংবাদ প্রকাশ করলে মুঠোফোনে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। এ ছাড়া অনেকের মাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করিয়েছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. বিল্লাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনভিত্তিক পাসপোর্ট কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় পাসপোর্ট পাওয়া এখন অনেক সহজ হয়েছে। শেরপুর পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীদের উপস্থিতি কম হওয়ায় সহজেই শতভাগ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। কিছু কিছু সেবাগ্রহীতা অনলাইনে আবেদন কার জন্য বাইরের কম্পিউটারের দোকানে সহযোগিতার জন্য গেলে দোকানের প্রতিনিধিরা বিভ্রান্তমূলক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

টাকা না দিলে হৃদয় ও সেলিম নামের দুই আনসার সদস্য সেবাগ্রহীতাদের পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতে দেন না, এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত ছিলাম না। আপনার মাধ্যমে জানলাম। এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ছাড়া সেবাগ্রহীতাদের জন্য দপ্তরের পক্ষ থেকে একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাসপোর্ট সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য, অভিযোগ ও পরামর্শ সেবা চালু করা হয়েছে।

এমজেইউ