ভারত কাছাকাছি হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ, তাদেরকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি দালালচক্র। সিন্ডিকেটের বাইরে কর্মকর্তারাও কিছু করেন না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

এসব অভিযোগের বিষয়ে পরিচয় গোপন রেখে সম্প্রতি অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্টের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এখানে স্থায়ী অফিসে কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নিচতলায় পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হত।

বর্তমানে পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে গড়ে উঠেছে ১৮ থেকে ২০টি কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকান। কিন্তু পাসপোর্ট অফিস হওয়ার আগে এই এলাকা ছিল জনমানব-শূন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিনই শতাধিক সেবাপ্রত্যাশী আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। পাসপোর্ট অফিসের সামনে গড়ে উঠা কম্পিউটার দোকানগুলোতে গেলে কাগজপত্র ঠিক করে দেওয়ার চুক্তি করেন দালালচক্র। সেখানেই মূলত পাসপোর্টের সকল সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার দরদাম চলে। আর এসবের মূলহোতা দালালচক্রের অন্যতম সদস্য রিমন। তিনি এই পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানগুলোর সামনে বসে থাকেন। পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে কারও নামের বানান বা জন্মসাল, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সার্টিফিকেট বা নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের মিল না থাকলে তিনিসহ অন্যান্য দালাল এবং কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানদাররা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কাজ করে দেন।

দালাল রিমন 

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক দোকানদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে ছোটখাটো ভুল যেমন : সার্টিফিকেটের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম, জন্মসাল, মা-বাবার নামের সঙ্গে অমিল থাকলে তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বে থাকা স্যারদের দিয়ে কাজ করে থাকি।

অফিসের কার মাধ্যমে কাজ করান জানতে চাইলে তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যান এবং বলেন আমি এর চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে বলতে পারব না।

প্রতিবন্ধী ছোট শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট করতে এসেছেন সুমি আক্তার। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কান্নাজনিত কণ্ঠে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পাসপোর্টের কাগজ জমা দেওয়ার পর ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। আমি তাকে ছবি তোলার অনুরোধ করলে উচ্চস্বরে বাগবিতণ্ডা করেন।

এমন সময় একজন (দালাল) এসে সুমিকে ডেকে নিয়ে যান।

পরবর্তীতে অন্য সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় রিমন (দালাল) আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, এখানে অনেকেই কাজ করে খায়। আর আপনারা আসছেন নিউজ করতে। পাবলিকের মাইর খেতে না চাইলে এখান থেকে চলে যান। পরে ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধির সঙ্গে থাকা প্রথম সূর্যোদয় পত্রিকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ইয়ামিন হাসান শুভের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান রিমন। একপর্যায়ে মারমুখী হলে কম্পিউটার ও ফটোকপি দোকানদার এবং অন্য দালালরা তাকে বারণ করলে কিছুটা শান্ত হন।

পাসপোর্ট অফিসের বাইরে গড়ে উঠা কম্পিউটারের দোকান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর এলাকা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা ইব্রাহিম নামের এক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেয়েছি। আমি আমার পাসপোর্টের আবেদন স্থানীয় একটি কম্পিউটারের দোকানে করেছিলাম। পরে কাগজপত্র নিয়ে জমা দিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদের চারিত্রিক সনদ না থাকায় প্রথম দিনে বাড়ি ফেরত গিয়েছি। তারপর চারিত্রিক সনদ নিয়ে এসে পাসপোর্ট ফরম জমা ও ছবি তুলে গিয়েছিলাম। আজকে পাসপোর্ট হাতে পেলাম। পাসপোর্ট পেয়ে খুব ভালো লাগছে।

নাচোল উপজেলার হাসান নামের এক সেবাপ্রত্যাশী বলেন, আমি গত বছরের অক্টোবর মাসে পাসপোর্ট করার ফরম জমা দেওয়ার জন্য অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আমার নামের বানান মিল না থাকায় ফাইল জমা নেয়নি। এ সময় পাসপোর্ট অফিসের সামনে কিছুটা হতাশ হয়ে বসেছিলাম। পরে মিলন কম্পিউটারের মাধ্যমে পাসপোর্টের ফাইল জমা দিয়েছি। প্রথমে মিলন কম্পিউটার ১ হাজার ৪০০ টাকা চেয়েছিল কিন্তু আমি এক হাজার টাকা দিয়ে পাসপোর্ট পেয়েছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্রফেসরপাড়ার এক যুবক নাম প্রকাশ না শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পাসপোর্টের আবেদনে পেশা হিসেবে কৃষক দেওয়া ছিল। পেশা কৃষক দেওয়ার কারণে অফিসে পাসপোর্ট ফাইল জমা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে এক দালালের (নাম জানা নেই) মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে জমা দিয়েছি।

ভোলাহাট উপজেলা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাসপোর্ট আবেদন কপি জমা দিতে গেলে আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নামের শুরুতে মো. না থাকার কারণে আবেদন ফেরত দেয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় তলায় সহকারী পরিচালকের রুমে গিয়ে তাকে বলার পর গ্রহণ করে। আমি মনে করি এটা একটা হয়রানির কৌশল।

তিনি আরও বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও স্থানীয় কিছু লোক অফিসে প্রবেশ করে এবং সাইড (লাইনের বাইরে থেকে) দিয়ে তার সঙ্গে থাকা অন্যের আবেদন জমা দিয়ে চলে যায়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিশ্বাস এই অফিসে কোনো দালাল নেই। তবে অফিসের বাইরে থাকতে পারে। এই ব্যাপারে আপনারা খোঁজখবর নেন।

এমজেইউ