নাজমুন নাহার রিনা

‘‌আমি একজন ডিভোর্সি নারী। পৃথিবীতে ডিভোর্সি নারীদের কেউ মূল্যায়ন করে না। ডিভোর্সি, স্বামী পরিত্যাক্তা, পথে কুড়ানো মেয়েদের কোনো মূল্য নেই।’ জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথাগুলো খুব সাবলীলভাবেই বলছিলেন বরিশালে নারীদের কর্মসংস্থানে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া নাজমুন নাহার রিনা। স্থানীয় কর্মসংস্থানে এই নারীর গল্প অনুপ্রেরণা হিসেবে শোনানো হয়। 

নাজমুন নাহার রিনার বাবা ছিলেন একটি দোকানের এক হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী। পরিবারকে ভালো রাখতে রিনা অল্প বয়সে কাজ নিয়ে পারি জমান বিদেশে। নিজের সম্বল এনে তুলে দেন স্বামীর হাতে। স্বামী জমি আর অলঙ্কার পেয়ে নাজমুন নাহার রিনাকে ডিভোর্স দেন। এতে রিনা ডুবে যান চরম অসহায়ত্বে। কখনো ভাবতেও পারেননি তার সুদিন ফিরবে। তবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এখন সব হারানো সেই রিনা দুটি কারখানার মালিক। 

নাজমুন নাহার রিনা বলেন, সমাজ আমাকে একদিন সবদিক থেকে বিমুখ করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম পরিশ্রম আর চেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখলে জয় আসবেই। যে সমাজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই সমাজ আজ আমাকে সম্মান করে। আমি মনে করি এই সম্মান আমার না, আমার কাজের।

বরিশাল বিসিকে বিসমিল্লাহ পলিমার অ্যান্ড প্যাকেজিং ও রিনা কটন মিলস নামে দুটি কারখানার মালিক রিনার অধীনে দেড় শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ১২শ নারী সাবলম্বী। কর্মক্ষেত্র বাড়িয়েছেন জুতা, নকশি কাঁথা, অলঙ্কার এবং পাটপণ্য তৈরিতে। দায়িত্ব পালন করছেন বরিশাল উইমেন চেম্বারের পরিচালক পদে।

নাজমুন নাহার রিনা বলেন, আমাদের হালিমা ফুফুকে দেখলাম একদিন পথের ধারে দুই বাচ্চা নিয়ে বসে কান্না করছিলেন। উনি আমার রক্তের কেউ নন। তবে একই মহল্লার বিধায় খুব কাছের ছিলেন। হালিমা ফুফু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমারতো ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাচ্চা নিয়ে এসেছি ভাইয়ের বাড়িতে। এখন ভাবিরা আমাকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সন্তান নিয়ে আমি এখন কী করবো? ওই দৃশ্যটি আমাকে খুব আঘাত করে। যেহেতু আমিও ডিভোর্সি। আমি ও আমার সন্তানদের সঙ্গে যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে কী করবো। আমি যদি নিজের পায়ে না দাঁড়াই তাহলে আমার সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। ওখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নেমে পড়লাম। ওখান থেকে শপথ করি, আমি নিজেতো স্বাবলম্বী হবোই পাশাপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত ৫০-১০০ নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। ওদের ভরসার জায়গা হবো।

নাজমুন নাহার রিনার জন্ম ১৯৭৪ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের উত্তমপুর গ্রামে। তার বাবা বারেক হাওলাদার ছিলেন নিম্নবিত্ত। মা রিজিয়া পারভীন। উত্তমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পরে বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেধার স্বাক্ষর রাখেন ক্লাসে।

নাজমুন নাহার রিনা বলেন, ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব। কিন্তু ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করার পর জীবনের জন্য সাঁতার দিতে হয়। বাবা তার বন্ধুর সাথে ব্যবসা করতে গিয়ে মূলধন হারিয়ে ভোলায় একটি দোকানে ১ হাজার টাকা বেতনে কাজ নেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আমি। পরিবারে অভাব লেগেই থাকতো। সেই অভাব থেকে মুক্তি পেতে পাড়ি জমাই ঢাকায়। সেখানে এক মামার বাসায় আশ্রয় নিয়ে একটি কলেজে ভর্তি হলেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ৮১০ টাকা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিই। ওই চাকরি করেই এইচএসসি পাস করি। বেতন অবশ্য বেড়ে ১৪শ টাকা হয়েছিল। সেই টাকায় নিজের চলা, পরিবারকে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু পরিবারকেও সাপোর্ট দিতে হচ্ছিল। আমি ছাড়া তখন পরিবারের বিকল্প আয়ের উৎস ছিল না।

ওই সময়ে চিত্রবাংলা পত্রিকা খুবই বিখ্যাত ছিল। সেই পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারলাম কুয়েতে নারী শ্রমিক নিচ্ছে। ১৯৯৭ সালে আমি কুয়েতে পারি জমাই। একটি পরিচ্ছন্নতা কোম্পানির সুপারভাইজার পদে সেখানে কাজে যোগ দেই। সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতাম। আমি জানতাম ওটাই আমার আমার জীবনের সব থেকে বড় সুযোগ। সুযোগ কাজে না লাগাতে পারলে কখনো আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। কিন্তু জানতাম না সেই ঘুরে দাঁড়ানোর পর আরও বড় বাধা অপেক্ষা করছে।

তিনি বলেন, ২০০৩ সাল পর্যন্ত কুয়েতে কাজ করে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাই। বাবাকে একটি দোকানের পুঁজি দেই। কুয়েতে এক ছেলের সঙ্গে সর্ম্পকে জড়িয়ে ইচ্ছা ছিল কুয়েতে থেকে যাবে। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে হয়। দেশে ফিরে মামার পছন্দে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই সন্তান হয়। বিদেশে থাকার টাকায় গাজীপুরে এক খণ্ড জমি, স্বর্ণালঙ্কার করেছিলাম। আর নিজের নামে ছিল ৮ লাখ টাকা। আড়াই বছরের সংসারে আমার স্বামীকে গাজীপুরের জমি আর স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দেই। কারণ তিনি কিছুই করতেন না। এটা ছিল তাকে কিছু করতে দেওয়ার পুঁজি। তিনি সব নিয়ে ২০০৬ সালে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন।

আমি আবার পথে বসে গেলাম। সব কিছু হারিয়ে কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম তখনই এই ঘটনা আমাকে এত বেশি আঘাত দেয় যা ভাষায় বোঝানো যাবে না। তবে ছোটবেলা থেকে আমি খুব জেদি ছিলাম। যেজন্য ডিভোর্সের পর জেদ নিয়ে শুরু করলাম সংগ্রাম। যা পুঁজি ছিল তা নিয়ে ফিরে আসি বরিশালে। এখানে এসে একটি পরিত্যাক্ত ঘর ভাড়া নিয়ে দুই সন্তান নিয়ে থাকতে শুরু করি। কিন্তু আমি কী করবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। শেষে দুটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ক্রয় করি। দিনে ৩শ টাকা ভাড়ায় সেই রিকশা ভাড়া দেওয়া শুরু করলাম। ভেবেছিলাম দিনে ৬শ টাকা হলে মাস চলে যাবে। এক মাস পরে দেখলাম অটো চালকরা ঠিকভাবে ভাড়া দিচ্ছে না। এবার পুরোপুরি ঝুঁকি নিলাম। একজনের পরামর্শে বরিশাল বিসিকে একটি টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে জুট মিল শুরু করি। যা পুঁজি ছিল পুরো টাকা দিয়েই কারখানাটা চালু করি। 

রিনা বলেন, ২০০০ সালের ডিসেম্বরে কারখানার কাজ শুরু করে পরের বছরের জুনে আমি উৎপাদনে যাই। প্রথম অবস্থায় মাত্র ৮ জনকে নিয়ে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে দুটি কারখানায় দেড় শতাধিক কর্মী কাজ করেন। এরপর দুইবার আমার কারখানা অগ্নিকাণ্ডে শেষ হয়ে যায়। তারপরও তিলে তিলে আবার গড়ে তুলেছি। আমি নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনেক কাজ করেছি। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই আমি কাজে ব্যয় করি। জুট মিল যখন শুরু করি তখন কারখানার প্রধান শ্রমিক ছিলাম আমি। কারখানায় উৎপাদিত পণ্য নিয়ে ‍ুদোকানে দোকানে যেতাম। তখন অনেক কথা শুনতে হতো। কিন্তু কোনো কিছুই আমাকে ফেরাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ১২০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

নাজমুন নাহার রিনা শুধু ব্যবসা নয়, নারীদের উন্নয়নে এখন রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়েছেন।

রিনার মেয়ে মাইসা ইসলাম লিয়া বলেন, আমার মা নারী উদ্যোক্তা। তিনি যখন ব্যবসা শুরু করেন তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম। তখন আমি কিছুই বুঝতাম না। আমি মাকে কাছে পেতাম না। আমারতো বাবা নেই। ফলে মা আর বাবা দুজনই ছিলেন আমার মা। আমার ছোটবেলা থেকেই মাকে খুব সংগ্রাম করতে দেখেছি। আমার মা কখনোই আমাদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি। আমি আমার মাকে নিয়ে অহংকার করি। এমন সংগ্রামী নারীই পারেন সমাজটাকে বদলাতে। তিনি আমার অনুপ্রেরণা।

বরিশাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, নাজমুন নাহার রিনা একজন সংগ্রামী নারী। তিনি অবহেলিত নারীদের অগ্রসরে কাজ করছেন। তার দুটি কারখানায় নারীরা কাজ করে সাবলম্বী হচ্ছেন। তার মতো করে সকলে কাজ করলে অবহেলিত নারীরা এগিয়ে যাবেন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর