বীর মুক্তিযোদ্ধা রহিমা বিবি। ঢাকা পোস্ট

আজ ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রাসঙ্গিকভাবে নারীদের স্মরণ করে এই দিনটিতে দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও অতীতে নারীদের অধিকারের স্বীকৃতির জন্য যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে, তা আজও করতে হয় এবং হচ্ছে। নারী শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের কথা মনে করিয়ে প্রতি বছর এ দিবস পালিত হলেও আজকের আধুনিক সময়ে এসেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে মেয়েরা। সব সময়ের ন্যায় নারীদের সম্মান জানাতে এবারও ঢাকা পোস্ট নারীদের নিয়ে বিশেষ আয়োজনে এ পর্বে থাকছে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার হরিপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা রহিমা বিবির ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নিজের আত্মত্যাগ ও স্মৃতিকথা।  

১৯৭১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে নারকীয় নির্যাতন যন্ত্রণায় কেটেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা রহিমা বিবির জীবন। ফেনী পাইলট হাইস্কুলের একটি কক্ষে পাক হানাদারদের নির্যাতনে বারবার জ্ঞান হারিয়েছেন। ফেনী পাইলট ও ফেনী কলেজ কম্পাউন্ডে তখন পাক হানাদার বাহিনীর বড় ক্যাম্প ছিল। সেখানে ছিল টর্চার সেলও। অনেক মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়। নিজের ওপর বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়ার সময় তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। ৫৩ বছর পরেও তার মনের ক্ষত এতটুকু শুকায়নি। ৬ ডিসেম্বর ফেনী মহকুমা হানাদার মুক্ত হলেও রহিমা বিবির মুক্তি মেলেনি। 

রহিমা বিবির পৈত্রিক নিবাস ছাগলনাইয়া উপজেলার হরিপুর এলাকায়। পরিবারে তার দুই ভাইও বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে রহিমা বিবি বলেন, হরিপুরে বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধারা ছদ্মবেশে আসতেন। কখনো কাজের লোক, কখনো জেলে সেজে রাজাকার ও পাক বাহিনীর ওপর নজর রাখতেন। সবসময় আমার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা হতো। তারাও বোন সম্বোধন করায় সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় তাদের গ্রেনেড, গুলি আগলে রাখতাম। কাছাকাছি দূরত্বে নিজেই একাধিকবার গ্রেনেড ও কার্তুজ বহন করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এসব তথ্য রাজাকারদের কাছে একসময় পৌঁছে যায়।

রহিমা বিবি বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামেই ছিলাম। বিভিন্ন সময় রাজাকাররা এসে বাড়ি থেকে হাঁস-মুরগি নিয়ে যেতেন। গোলা হতে ধান, গাছ হতে ফল। আমার এক ভাই পাকিস্তান থেকে, আরেক ভাই পড়ালেখা করা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। প্রায় সময় ভাইদের খোঁজ নিতে গেলে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিত। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের কোনো এক রাতে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী আমাকে ঘর হতে তুলে নিয়ে যায়।

পাকিস্তানিদের নির্যাতনের কথা তুলে ধরে রহিমা বিবি বলেন, দুইমাসে তালাবদ্ধ একটি রুমে বন্দি ছিলাম। সেখানে পাশের রুমগুলোতে আরও অনেক মেয়ে বন্দি ছিল। মূলত আমার দুই ভাইয়ের প্রতিশোধ নিতে সেদিন আমাকে তুলে নিয়ে যায়। 

জানা গেছে, দেশের জন্য সম্ভ্রম দিয়েছেন রহিমা বিবি। অথচ সমাজ হতে বাঁচতে স্বাধীনতার পর কিছুদিন গোপনে থাকতে হয়েছিল তাকে। সমাজে কথা রটে যায়। ১৯৭৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বামী সবকিছু মেনে নিলেও সন্তানরা সহজে মানতে পারেননি।

রহিমা বিবিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকার একটি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এর আগে অনেক দেনদরবার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এতো আত্মত্যাগের পরেও তাই বহুবছর ছিলেন সুবিধাবঞ্চিত।

তারেক চৌধুরী/এএএ