‘হুইনছি (শুনেছি) আইয়ুবদেরকে ডাকাতরা আটকায় হালাইছে (রেখেছে)। মোবাইলও লই (নিয়ে) গেছে। হেগুনরে (তাদের) হরে (পরে) কোনানে (কোন খানে) লই (নিয়ে) গেছে। এখন আল্লাহ কইতে হারে, আমার বাবা কীভাবে আছে? আমি আমার ছেলেরে ফেরত চাই। ও আল্লাহ আমার ছেলেরে ফেরত দেন। আল্লাহ আমনে আমার ছেলের জন্য, তাদের জন্য রহমত দেন। ঘটনাটি শুনার পর থেকে আমি নামাজ ও কোরআন পড়ে তাদের জন্য দোয়া করছি। আমি যেন আমার ছেলেরে আমার বুকে ফিরে পাই। ও আল্লাহ, আমার ছেলেরে আমার বুকে ফেরত দেন।’ 

এভাবেই কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজে থাকা ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খানের মা হোমায়রা বেগম। বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুরে বাড়িতে গিয়ে আইয়ুবের মাসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের টিনশেড ঘরটিও জরাজীর্ণ। ক্যামেরার সামনে তার মা আসতে চাননি। দরজার ফাঁক দিয়ে কথা বলেন তিনি। 

আইয়ুব লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের রাখালিয়া গ্রামের বিরন বেপারী বাড়ির মৃত আজহার মিয়ার ছোট ছেলে। তিনি রাখালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রামগঞ্জের ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া একাডেমি থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।

আইয়ুবের মা হোমায়রা বেগম বলেন, আইয়ুব ফেসবুকে লেখেছে, ‘আমার বাবা আমারে খুব ভালোবাইসতো। কিন্তু আমি বাবা মরার সময় সাথে ছিলাম না’। এসব বলেই ছেলেকে ফিরে পেতে আর্তনাদ করেন তার মা। 

এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি আইয়ুবের বাবা আজহার মিয়া মারা যান। স্বামীর শোক না কাটতেই ছেলের চিন্তায় কাতর হোমায়রা। ভারত সাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি রয়েছে আইয়ুবসহ ২৩ জন বাংলাদেশি নাবিক।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হোমায়রা বেগম বলেন, আমি আমার বাবারে চাই। আমি আর কি চাইতাম। প্রতিদিনই আইয়ুব তার বাবার জন্য শোক করে। সোমবার বিকেলে আইয়ুব আমাকে বলেছে, আম্মা আপনি কোরআন শরীফ পড়েন। আমিও পড়ছি। ১০ রমজানের মধ্যেই আব্বার জন্য মিলাদ পড়াবো। এজন্যই আমি দুদিন ধরে কোরআন শরীফ জান-প্রাণ দিয়ে পড়ছি। আইয়ুবও পরশু ধরে কোরআন শরীফ পড়া শুরু করেছিল। আল্লাহ আপনি রহমত নাজিল করে দেন।

জানতে চাইলে হোময়রা বেগম জানান, সোমবার বিকেলে আইয়ুব তার সঙ্গে শেষবার কথা বলেছে। মঙ্গলবার তার অন্য ছেলেদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কেউ তাকে কিছু জানায়নি। গত রাতে তিনি নাতির কাছ থেকে শুনে মেজো ছেলেকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানতে চান। মেজো ছেলে তাকে জানিয়েছে, আইয়ুবের জন্য চিন্তা না করতে। ভারত মহাসাগরে আইয়ুবদের জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুরা অস্ত্র ঠেকিয়ে কব্জা করেছে। এসব শোনার পর থেকেই কান্নাই তার (হোমায়রা) সম্বল, সারারাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। আইয়ুবের কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। তার ছেলে কীভাবে, কেমন আছে? এসব বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

হোমায়রা বেগম বলেন, প্রায় ১ বছর ধরে ইন্টার্ন করছে আইয়ুব। অনেক কষ্ট করে তার বাবা তাকে পড়ালেখা করিয়েছে। বেতনও এখনো তেমন পাচ্ছে না। আমাদেরকেও দিতে পারতো না। আমার স্বামী মারা যাওয়ার ২০-২৫ দিন আগে সর্বশেষ আইয়ুব বাড়িতে এসেছিল। একদিন থেকেই পরে চলে গেছে। কোম্পানির লোকজনই তাকে পাঠিয়েছে। তার বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করতেই মনে হয় আল্লাহ তখন তাকে বাড়িতে এনেছিল।

আইয়ুবের বন্ধু আবদুল্লাহ আল মারুফ বলেন, আইয়ুব আমার খুব ভালো বন্ধু। আমরা তাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে চাই। সে যেন দ্রুত আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে।

আইয়ুবের প্রতিবেশী ভাতিজা তারেক হোসেন, আইয়ুব চাচা ভালো মানুষ। আমাদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করতেন। আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। আমরা তাকে দ্রুত ফেরত চাই।

রাখালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি দেবনাথ বলেন, আইয়ুব আমাদের গর্বিত শিক্ষার্থী। সোমালিয়ায় সাগরে জলদস্যুদের কবলে রয়েছে আইয়ুবসহ তার সহকর্মীরা। আমরা সুস্থ অবস্থায় তাকে ফেরত চাই। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদের সদস্য মামুন বিন জাকারিয়া বলেন, ঘটনাটি খুব দুঃখজনক। আইয়ুবকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই। যাদের মাধ্যমে আইয়ুবসহ সবাইকে ফেরত পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারে তাদের সকলের জোরালো ভূমিকা চাই।

প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এ সময় শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে নেয় সোমালিয়ান দস্যুরা। এদিন বিকেলে জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। জাহাজে লক্ষ্মীপুরের আইয়ুব খানসহ মোট ২৩ জন নাবিক রয়েছেন।

আরএআর