ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কাছে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজে থাকা ২৩ জন নাবিকের মধ্যে নেত্রকোণার একজন ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। তার নাম মো. রোকন উদ্দিন। তিনি সদর উপজেলার ঠাকুরাকোণা ইউনিয়নের বাঘরোয়া গ্রামের দিনমজুর বাবা মিরাজ আলী ও মা লুৎফুন্নাহার বেগমের ৫ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। 

জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর রোকনের  স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেতে আকুতি জানিয়েছেন স্বজনরা। 

রোকন উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা লুৎফুন্নাহার ছেলের জন্য কান্না করতে করতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরতেই আবার ছেলের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। বিলাপ করে বলছেন, মানুষ হাসাহাসি করতো, বলতো- ‘বাপে কামলা দেয়, ছেলে এত বড় চাকরি কেমনে পাইব? টাকা কই পাইব?’ আমি শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছি। সুদে টাকা আনছি, জমি বিক্রি করছি, আত্মীয়-স্বজন সবাই সহযোগিতা করছে। এই ছেলের ঋণের জন্য মানুষ আমাকে দরবারে অপমান করছে। আমি হাত দিয়ে চোখ দুইটা মুইছা বলছি আমাকে দুইটা কিল মারেন, তাও আমি এখন টাকা দিতে পারতাম না। 

ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কবে কথা হয়েছে জানতে চাইলে লুৎফুন্নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম রোজার দিন ইফতারের ৪৫ মিনিট আগে ছেলের সাথে সর্বশেষ কথা কইছি। আমি কইলাম বাবা খাইয়া নেও। সে বলছে আমি রোজা রাখছি মা, এখন খাব না। আর একটু পরে ইফতার করব। এটাই আমার ছেলের সাথে সর্বশেষ কথা। এরপর আর ছেলের সাথে কথা বলতে পারি নাই। শেষ কথাটা হয়েছে অডিও কলে। ভিডিওতে ছেলের মুখটা দেখতে পারলাম না। কয়দিন পর রোকন সন্তানের বাবা হওয়ার কথা রয়েছে। আল্লাহ যেন তার সন্তানের মুখটা দেখার সৌভাগ্য দান করেন।  প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি, আমার পুতেরে আমার কোলে ফিরায়া দেও। পাশাপাশি সব মায়ের সন্তানদের তাদের কোলে ফিরায়া দাও।

রোকনের বড় ভাই মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, আমার মোবাইল বন্ধ ছিল, যার কারণে আমারে হয়তো ফোনে পায় নাই। অন্য আরেকজনের মোবাইল সে একটা ভয়েস ম্যাসেজ পাঠাইছে। পরে প্রতিবেশী একজন ওইটা আবার আমার কাছে  পাঠাইলে তখন আমি জানতে পারি বিষয়টা। খবরটা পাইছি শুধু এ পর্যন্তই। এরপরে আর এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। খুব টেনশনে আছি ভাই। ভাইটারে এত কষ্ট কইরা ক্ষেতে কাজ-কাম কইরা পড়াশোনা করাইলাম, চাকরিতে ঢুকাইলাম।  এখন ভাই জলদস্যুর কাছে আটকা পড়ছে। সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি আমার ভাইকে জলদস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করে আমার মায়ের কোলে ফিরাইয়া দেন। আর কোনো দাবি নাই আমাদের।

রোকনের বোন শাহীমিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোকন সর্বশেষ তার স্ত্রী তানিয়া আক্তারের সঙ্গে কথা বলেছে। জলদস্যুরা যখন জাহাজটিকে ঘিরে ফেলেছে তখন রোকন তার স্ত্রীকে জানায়, জলদস্যুরা তাদের মোবাইল নিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তোবা ফোনে কথা বলা যাবে না। এরপর তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় মা, বাবাসহ বাড়ির লোকজনের মাঝে দুঃশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে রোকনের বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছেন এলাকাবাসী। তারাও শঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

রোকনের প্রতিবেশী আব্দুল লতিফ বলেন, রোকন ছেলেটা খুব ভালো। খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। ওদের জমি-জমা ছিল না, অন্যের জমিতে কাজ করে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। এখন বর্তমানে চাকরি করে কিছু জমি জমা কিনেছে। আগে কিছুই ছিল না। এখনো তার বাবা-ভাই কৃষি কাজ করে সংসার চালায়। তার চাকরির টাকা দিয়ে এই বাড়িটা করছে। কিন্তু এখনো অনেক টাকা ওদের ঋণ রয়েছে। ওর কিছু হলে পরিবারটা পানিতে পড়ে যাবে।

ঠাকুরাকোনা ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. একলাছ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই ছেলেটিকে তার পরিবার অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছে। তার বাবা ও ভাই মানুষের বাড়িতে কাজ করে তাকে পড়াশোনা করিয়ে চাকরিতে ঢুকিয়েছে। ওদের পরিবারের সবাই ভালো মানুষ। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, রোকনকে যেন তারা সুস্থ ও সুন্দরভাবে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন।

প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এ সময় শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটির নিয়ন্ত্রণে নেয় সোমালিয়ান দস্যুরা। বিকেলে জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। জাহাজে ২৩ জন নাবিক রয়েছেন।

চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরএআর