সিরাজগঞ্জ শহরের হোসেনপুর মহল্লায় হোসেনপুর লাল মসজিদ অবস্থিত। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাসে গড়া ১৪৮ বছরের এই মসজিদটি যেন এই এলাকার মুসল্লিদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি দীর্ঘদিন ধরে রেখেছে হাজারো স্মৃতি। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি, ত্যাগ, দ্বন্দ্ব ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর নির্মাণ হওয়া মসজিদটির রক্তের লাল অনুযায়ী নামকরণ করা হয় হোসেনপুর লাল মসজিদ। পুরো মসজিদটিই নির্মাণ করা হয়েছে রক্তের রঙে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তারও প্রায় ২০ বছর আগে। কিন্তু নানা বাধা-বিপত্তিতে মসজিদ নির্মাণে দেরি হয়। এটাই জেলার প্রথম পাকা মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটিতে নামাজ পড়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীসহ ঐতিহাসিক অনেক ব্যক্তিই। মসজিদটিতে এখনো শুক্রবারে জুমার নামাজ ও ঈদের নামাজে ৭০০ থেকে হাজারের অধিক মুসল্লি অংশ নেন। যার জামাতের সারি তিনতলা মসজিদ ছেড়ে চলে আসে মসজিদের মাঠ প্রাঙ্গণে। 

হোসেনপুর এলাকার বয়োবৃদ্ধ মুসল্লি ও মসজিদ কমিটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মসজিদ স্থাপন নিয়ে তৎকালীন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল সিরাজগঞ্জ শহরের হোসেনপুর মহল্লার মুসল্লিদের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ও অন্যান্যদের সঙ্গে ঝামেলাও হয়েছিল। একপর্যায়ে প্রভাবশালী জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলেও মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মুসল্লিরা। এরপর মসজিদটি নির্মিত হলে নামকরণ করা হয় ‘হোসেনপুর লাল মসজিদ’।

হোসেনপুর এলাকার বয়োবৃদ্ধ মুসল্লিরা মসজিদটি নির্মাণের ইতিহাস জানান। তারা বলেন, প্রায় দেড়শ বছর আগে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন প্রখ্যাত আলেম মুন্সী মেহের উল্লাহ হোসেনপুর এলাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও প্রভাবশালী জমিদার ও তার লোকজন মসজিদ নির্মাণে বাধা দেন। এ নিয়ে জমিদারের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিমদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একপর্যায়ে মুন্সী মেহের উল্লাহসহ স্থানীয় মুসল্লিরা শপথ নেন- প্রয়োজনে জমিদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে জীবন দেবেন তবুও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করবেন। এমন পরিস্থিতিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর জমিদারদের বাধা উপেক্ষা করে ১৮৭৬ সালে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মুন্সী মেহের উল্লাহর দান করা জমির ওপর ছোট্ট পরিসরে মসজিদ এবং এর সামনে ঈদগাহ মাঠ তৈরি করা হয়। 

মসজিদটি নির্মাণে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে হোসেনপুর গ্রামবাসী। পরবর্তীতে একতলা ভবন করা হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ লাল রঙের। যার ছিল সর্বমোট ছয়টি গম্বুজ। এ সময় মুন্সী মেহের উল্লাহর সহযোগী ছিলেন দামি উল্লাহ মিয়া ও হিসাব উদ্দিন মিয়া। মসজিদটির পরবর্তী সহযোগিতা ও পরিচালনায় ছিলেন দামী উল্লাহর ছেলে রিয়াজ উদ্দিন মিয়া ও ভাতিজা ইব্রাহীম নায়েব। স্বাধীনতার পরে মসজিদটির পরিচালনা পর্ষদ কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন বজলার রহমান অটো ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলতাফ হোসেন।

কিন্তু মসজিদের পুরাতন ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় ১৯৯০ সালে সেটি ভেঙে একই স্থানে নতুন দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। ওই সময় ফজলে রাব্বী হারুন নামে হোসেনপুর এলাকার এক ব্যক্তি মসজিদটি পুনর্নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতা করেন ও নানান জায়গা থেকে আর্থিক সহযোগিতা ও নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করে দেন। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার কাজে হাত দেয় মসজিদ কমিটি। গ্রামবাসীর আর্থিক সহায়তা ও শ্রমের মাধ্যমে ২০১৮ সালে তৃতীয় তলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। 

মসজিদটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে আছেন মফিজুল ইসলাম জিন্নাহ, সহ-সভাপতি আমির হোসেন সুরুজ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন সুরুজ আলী মিস্ত্রী। এছাড়াও মো. সানোয়ার হোসেন, জাহিদ আহমেদ রনো, মনোয়ারুল ইসলাম নিপু, ইসতিয়াক আহমেদ তমাল ছাড়াও কমিটির বাইরের আব্দুল মালেক, সোহেল আব্বাসসহ স্থানীয় অসংখ্য মুসল্লিরা অবদান রেখে চলেছেন। যাদের মেধা ও পরিশ্রমে এখনো সুন্দর মতো চলছে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি। 

এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি মো. সানোয়ার হোসেন (৭০) ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা জেনেছি তৎকালীন জমিদারের সঙ্গে মুন্সী মেহের উল্লাহর নেতৃত্বে মুসল্লিদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে মসজিদটি তৈরি হয়েছে। ফলে মসজিদটির নামকরণ হয়েছে লাল মসজিদ। মসজিদটির প্রধান প্রতিষ্ঠাতা মুন্সী মেহের উল্লাহ। তাকে পরবর্তীতে সহযোগিতা করেছিলেন মুন্সী দামি উল্লাহ, ইব্রাহীম নায়েব ও হিসাব উদ্দিন। এরপর পুনরায় মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন ফজলে রাব্বী হারুন। পরে এই গ্রামেরই সন্তান সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, তার ভাই মঞ্জুর হাসান মাহমুদ খুশীসহ গ্রামের সবার সহযোগিতায় দ্বিতীয় তলা সম্পন্ন হয়। ২০১৭-১৮ সালের দিকে গ্রামের সবার সার্বিক সহযোগিতায় মসজিদটি সম্পন্ন হয়। 

তিনি বলেন, এটা মূলত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ছিল। তাই তখনকার জমিদাররা মসজিদ করতে বাধা দেয়। এ কারণেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেই সময় তাড়াশের রায় বাহাদুর জমিদারের কাছ থেকে জমিটি লিখে নিয়ে এসে মসজিদটির উদ্যোগ নেওয়া হয়।  

মসজিদে নামাজ পড়তে আসা নান্টু শেখ ও স্বপন মাহমুদ নামে দুই মুসল্লি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মসজিদে নামাজ পড়তে তো সবারই ভালো লাগে, তবে এমন ঐতিহ্যবাহী মসজিদে নামাজ পড়তে আসলে একটা আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। এখানে নামাজের আগে খুব সুন্দর সুন্দর বয়ান হয়। এই মসজিদে নামাজ পড়তে ঢুকলেই মনে পড়ে আগেকার সময়ের মানুষেরা ধর্মের জন্য কত কষ্ট করেছেন। এখন তো যেখানে সেখানেই অনেক মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু একটা মসজিদ নির্মাণের জন্য যে রক্ত পর্যন্ত দিতে হয় এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।  

মসজিদটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য জাহিদ আহমেদ রনো ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। আমরা যতটুকু জানতে পারি এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ১৮৫৫ সাল থেকে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ও চড়াই-উতরাইয়ের কারণে করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ১৮৭৬ সালে ছোট্ট পরিসরে একটা ভবন আকারে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। ওই ভবনটিও একটা সময় জরাজীর্ণ হয়ে যায়। 

তিনি বলেন, আমরা মুরব্বিদের কাছ থেকে যেটা জেনেছি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিরাজগঞ্জে যখন সফরে এসেছিলেন তখন এই মসজিদে সালাত আদায় করে গেছেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী এই মাঠে (বর্তমান সিরাজগঞ্জ স্টেডিয়াম) মিটিং করেছেন। তখন তারা এখানে সালাত আদায় করেছেন। এটা জেলার প্রথম পাকা মসজিদ। সিরাজগঞ্জসহ সারাদেশের মানুষই এটাকে ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হিসেবেই জানেন। 

আব্দুল মালেক নামে মসজিদের এক দাতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের কাছ থেকে অনুদানের মাধ্যমে জমি নিয়ে তৎকালীন হিন্দুদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে নামকরণ করা হয় লাল মসজিদ। তখন সেটাই প্রথম পাকা একমাত্র মসজিদ। সিরাজগঞ্জের মানুষসহ পুরো দেশের মানুষ এই মসজিদের নাম জানে। গ্রামের সবার সহযোগিতা ও কমিটির দক্ষ নেতৃত্বে মসজিদটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকেও মুসল্লিরা জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন। আমরা আশা করি মসজিদটি সামনে আরও সুন্দর হবে।
 
ঐতিহ্যবাহী হোসেনপুর লাল মসজিদ কমিটিতে টানা ৯ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সুরুজ আলী মিস্ত্রী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মসজিদটির অনেক লম্বা ইতিহাস। মুন্সী মেহের উল্লাহ, মুন্সী দামি উল্লাহ, ইব্রাহীম হোসেনের পিতা হিসাব উদ্দিন তারাই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৭৬ সালে। তৎকালীন জমিদারদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে তৈরি হয় মসজিদটি। মসজিদটিতে সুদক্ষ ঈমাম দ্বারা কোরআন ও হাদিসের আলোচনা হয়। মসজিদটি তিন তলা হলেও আমরা জুমার নামাজে জায়গা দিতে পারি না। জামাতের সারি মাঠে চলে আসে।

তিনি বলেন, এখানে একটি পারিবারিক কবরস্থান আছে, যেখানে অনেক সুনামধন্য লোক শুয়ে আছেন। যার মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের হাইকমিশনার সৈয়দ আকবর আলী, তৎকালীন পাবনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ মাহমুদ, এই মসজিদের প্রতিঠাতা মুন্সী মেহের উল্লাহ, ডা. সাদেক আলী তালুকদার, জালাল সরকার, ইব্রাহীম হোসেন নায়েব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেনসহ অনেক নামিদামি ও গুণী ব্যক্তি। 

মসজিদ প্রাঙ্গণে থাকা আম গাছটির ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা ৫০ বছর হলো গাছটি এভাবেই দেখছি। শুনেছি মসজিদের বয়স আর এই গাছের বয়স সমান। 

মসজিদটির ঈমাম মো. হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে আল্লাহ তায়ালা এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদের ঈমাম হিসেবে কবুল করার জন্য তার নিকট শুকরিয়া আদায় করি। আমি ৫ বছর ধরে এখানে খেদমতে আছি। এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি অন্যান্য জায়গার চেয়ে ভালো। 

তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জে তো আরও মসজিদ আছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে মুসল্লিরা সিএনজি ও অটোরিকশা ভাড়া করে এখানে জুমার নামাজ পড়তে আসেন। কিসের জন্য আসেন? কারণ এখানে অন্যান্য মসজিদ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। যার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিদের এখানে সমাগম হয়। এছাড়াও কমিটির লোকজন ও গ্রামবাসীও খুব ভালো। যে কোনো সমস্যা হলে সবাই মিলে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন। 

আরএআর