নড়াইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ, সিস্টেমে গেলে সহজেই পাসপোর্ট মেলে নড়াইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। আর নিজেরা আবেদন করে জমা দিতে গেলে পোহাতে হয় ভোগান্তি। কিন্তু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা।

জানা যায়, চলতি বছরের শুরুতে নড়াইল শহরের নতুন বাস টার্মিনালের ওপর পাশে নান্দনিক নতুন ভবনে সেবা প্রদান শুরু করে নড়াইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। সম্প্রতি অফিসের আনসার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অফিসে প্রতিদিন গড়ে ৭০-৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী সেবা নিতে আসেন। এর আগে নড়াইল শহরের আলাদাৎপুর এলাকায় ভাড়া ভবনে নড়াইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

সাধারণ মানুষকে সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কি না তা জানতে সম্প্রতি পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট অফিসে যায় ঢাকা পোস্টের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি। দেখা যায়, নতুন অফিসের পাশেই গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কম্পিউটারের দোকান। সেখানে ভিড় করছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। কেউ নতুন পাসপোর্টের আবেদন করছে, কেউ পুরাতন পাসপোর্টের হালনাগাদ, আবার কেউ ভুল সংশোধনের আবেদনের জন্য এসেছেন। পরিচয় গোপন রেখে অফিসের সামনে ভিসা প্রসেস নামে একটি কম্পিউটারের দোকানে যায় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক।

নতুন পাসপোর্ট করতে খরচের ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই কম্পিউটারের দোকানদার মো. ইবন খান বলেন, পাসপোর্ট সৎভাবে করবেন নাকি অসৎভাবে? লাইন দুইটাই আছে। সৎভাবে করলে নিজে করতে হবে। আর অসৎভাবে করলে আমরা করে দেব। আমাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করলে কোনো জটিলতা পোহাতে হবে না। নিজে পাঁচ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট করতে লাগবে ৪০২৫ টাকা আর ১০ বছরের জন্য লাগবে ৫৭৫০ টাকা। তবে পোহাতে হবে ভোগান্তি। অফিসে গেলে কাগজপত্র জমা নেবে না। তবে ‘হ্যাডম’ দেখাতে পারলে জমা নেবে। আর আমাদের মাধ্যমে করলে পাঁচ বছরের জন্য লাগবে ৬ হাজার টাকা, আর ১০ বছরের জন্য লাগবে সাড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকা। এতে থাকবে না কোনো ভোগান্তি। কাগজপত্রে দেওয়া থাকবে সাংকেতিক চিহ্ন। পাসপোর্ট অফিসে জমা দিলেই সাংকেতিক চিহ্ন দেখলে ভোগান্তি ছাড়া কাজ সম্পন্ন হবে।

অতিরিক্ত টাকা কোথায় কোথায় যায় এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইবন খান চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তিনি জানান, অতিরিক্ত যে টাকা নেবেন তার থেকে ১১০০ টাকা দেন পাসপোর্ট অফিসের সংশ্লিষ্টদের, আর বাকি টাকা তার।

ভিসা প্রসেসের দোকানদার মো. ইবন খান (সাদা টিশার্ট পরা)

দোকান থেকে বের হয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় শহরের অলিতে-গলিতে থাকা আরও অনেক দোকানেই এমন কাজ হয়ে থাকে।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক কথা বলেন পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে আসা কয়েকজন সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে। তারা তুলে ধরেন হয়রানির কথা। তবে এখনো পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় হয়রানির ভয়ে পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন তারা।

নতুন পাসপোর্ট তৈরির অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে দুই যুবক জানান, তারা এসেছেন জেলার কালিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে। নিজেরা নতুন পাসপোর্টের আবেদন করে কাগজপত্র জমা দিতে প্রথম দিন এসে ফিরে গেছেন। ছোট একটি ভুল দেখিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা নেয়নি পাসপোর্ট অফিস। দ্বিতীয় দিন প্রত্যন্ত সেই এলাকা থেকে সময় ও অর্থ ব্যয় করে ফের এসেছেন কাগজপত্র জমা দিতে। তাদের দাবি, আজ তাদের কাগজপত্র যেভাবে জমা নিয়েছে, আগের দিন একইভাবে জমা নিতে পারত। তাহলে তাদের এত হয়রানি হতে হত না।

ভোগান্তি এড়াতে চাইলে বেশি টাকা লাগলেও নিজে না করে কম্পিউটারের দোকান থেকেই পাসপোর্ট করা ভালো বলে অভিযোগ করেন এই দুই সেবাপ্রত্যাশী।

এ সময় কথা হয় পাসপোর্ট নিতে আসা সদর উপজেলার আরেক তরুণের সঙ্গে। তিনি জানান, অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কম্পিউটারের দোকান থেকে পাসপোর্ট আবেদনের কাজ করিয়েছেন। তাই আবেদন জমা দিতে কোনো সমস্যা হয়নি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নড়াইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণ জনগণ আবেদন করতে কম্পিউটার দোকানে গেলে তারা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নেন। এর সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কোনো সম্পর্ক নেই। আর পাসপোর্ট অফিস জন্মলগ্ন থেকে যেভাবে হয়ে আসতেছে আমি সেটা কমাতে পারি, নির্মূল করা আমার দ্বারা সম্ভব না।

তিনি আরও বলেন, আমি এখানে এসেছি মাত্র এক মাস হয়েছে। আমি চেষ্টা করছি মানুষকে সেবা দেওয়ার। আমার নির্দেশ দেওয়া আছে, অফিসে সেবা নিতে এসে কেউ যেন ফিরে না যায়। আর কোনো সমস্যা হলে আমার কাছে এলে আমি দেখব।

এ বিষয়ে কথা হয় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনেছি পাসপোর্ট অফিস ভালো সেবা দিচ্ছে। তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে আগামী উন্নয়ন সমন্বয়ক মিটিংয়ে ওই অফিসকে (পাসপোর্ট অফিস) এ ব্যাপারে বলে দেওয়া হবে।

এমজেইউ