শুকনো মৌসুমে সিরাজগঞ্জের যমুনায় জেগে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য বালুচরে সবুজ প্রকৃতি ফসলের মাঝে চরাঞ্চলের নতুন পলিমাটিতে মরিচের ব্যাপক চাষ হয়েছে। মানুষের কাছে ব্যাপক চাহিদা থাকায় চাষিরা শুকনো মরিচকে তুলনা করছেন ‘লাল সোনা’র সঙ্গে। চলতি বছর মরিচের বাম্পার ফলন ও ভালো দামে হাসি ফুটেছে এসব কৃষকের মুখে।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সদরে ৬৮০ হেক্টর, কাজিপুর ৪৪০, রায়গঞ্জ ৪৬৫, উল্লাপাড়া ৯৫, কামারখন্দ ৭৮, চৌহালী ৭০, শাহজাদপুর ২২, তাড়াশ ১০ ও বেলকুচি উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। চাষ করা মরিচের মধ্যে হাইব্রিড জাতের বিজলী, যমুনা, রশনী, ঝিলিক উন্নত জাতের মধ্যে বারি-৩, সুপার সনিক, রংপুরী, বগুড়া ছাড়াও স্থানীয় জাতের মরিচের ব্যাপক আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে মরিচের উৎপাদন হয়েছে ১০ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন। এ বছর জেলায় শুকনা মরিচের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৪৮৮ মেট্রিক টন। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে যাচ্ছে। এতে অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় চাষীরা।

সম্প্রতি দেখা গেছে, যমুনার বিস্তৃত চরাঞ্চল জুড়ে মরিচের ক্ষেত। কৃষাণ-কৃষাণীরা দলবেঁধে জমি থেকে লাল, সবুজ মরিচ তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জমি থেকে মরিচ তুলে বস্তাবন্দি করছেন। প্রতিদিন দূরদূরান্তের মরিচের পাইকাররা এখান থেকে মচির ক্রয় করে নদীপথে নিয়ে যাচ্ছেন আড়তে। সেখান থেকে জেলার চাহিদা মিটিয়ে চলে যাচ্ছে সারা দেশে।

স্থানীয় বাজার সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে। আর শুকনো মরিচ মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেগে ওঠা চলগুলোতে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত কাঁচামরিচ ও শুকনো মরিচ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে প্রতি সপ্তাহের শনি ও বুধবার কাজিপুর উপজেলার নাটুয়াপাড়া হাটে পাইকররা এসে মরিচ ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের বড় বড় কোম্পানির ব্যাপারীরাও এখানকার মরিচ ক্রয় করছেন। এতে ফলন ও ভালো দাম পেয়ে চরের কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।

মরিচ চাষীরা জানান, এ চাষাবাদে বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে। মৌসুমে ৩ থেকে ৪ দফা পানি সেচ ও সামান্য সার কীটনাশক ছাড়া এ চাষাবাদে তেমন কোন খরচ ও ঝামেলা নেই। মরিচ লাগানোর পরে ৬০ থেকে ৭০ দিনের মাথায় তা উঠানো শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে একবার করে প্রায় তিন মাস একটানা ক্ষেত থেকে মরিচ তোলা হয়। অল্প খরচে স্থানীয় কৃষকরা অন্য ফসলের চেয়ে এ চাষাবাদে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। এই মরিচগুলো জমি থেকে উঠানোর পর চাষিরা যমুনার চরে একটানা ১২/১৫ দিন শুকিয়ে রাখেন। এ কাজে বাড়ির নারীরাও সমানভাবে যুক্ত থাকেন। মরিচ লাগানো, উঠানো, শুকানো ও বস্তায় ভরা পর্যন্ত পুরুষদের সহযোগিতা করেন নারীরা। বাড়তি আয়ের আশায় সবাই একযোগে এই কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে প্রতি বছর এ চাষাবাদের পরিধি বেড়েইে চলেছে। এখানকার উৎপাদিত মরিচের ব্যাপক ঝাল থাকায় দেশজুড়ে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সোনামুখী ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের মরিচ চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, ১ বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ৩২ হাজার টাকা। শুকনো মরিচ বাজারে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। বর্তমান বাজারে তার উৎপাদিত চার মণ মরিচ ৯৬ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান এই চাষি।

নাটুয়াপাড়া চরের মরিচ চাষি ছালাম শেখ বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে ২ বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছি। এরই মধ্যে ৪০ মণ কাঁচামরিচ বিক্রি করেছি। আরও ৮ মণ মরিচ শুকিয়ে রেখেছি। এখন যদি শুকনো মরিচ বিক্রি করি তাহলে প্রায় দেড় লাখ টাকার বেশি মরিচ বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।

গুটিয়ার চরের মরিচের পাইকার আমজাদ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে চরাঞ্চলের মাঠ থেকে কাঁচা পাকা মরিচ কিনে আড়তে বিক্রি করি। চরাঞ্চল থেকে মরিচ কিনে ঘোড়ার গাড়িতে করে নৌকা ঘাটে নেওয়া হয়। পরে নদীপথে শহরের আড়তে আনা হয়। সেই মরিচ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় সারা দেশের বাজারে। পাইকারি, খুচরা মরিচ কেনার পাশাপাশি তিনি কৃষকদের জমির পুরো মরিচ খেত কিনে নেন। পরে শ্রমিক দিয়ে মরিচ তুলে বিক্রি করেন। আবার জমি থেকে মরিচ শুকনো করেও বিক্রি করেন। এ বছর  ২০০ মণ মরিচ ক্রয় করে বিক্রি করেছেন তিনি। আমজাদের মতো এই চরাঞ্চলে প্রায় ৩০ জন মরিচের পাইকার রয়েছে। তারাও একইভাবে মরিচ কেনা-বেচা করে থাকেন।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার সাদাত জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সদর উপজেলায় ৬৮০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতায় এবারে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ৫০ থেকে ৬০ মণ মরিচের ফলন হয়েছে। ফলন ও দাম ভালো পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (উপ-পরিচালক) বাবলু কুমার বলেন, এ বছর জেলায় ১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৪৮৮ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। মরিচের বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা খুশি। যা চরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে। আগামীতে কৃষকেরা মচির চাষে আগ্রহী হবে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।

এএএ