রংপুরে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) অধীনে দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের আবেদনের ১৬ বছর পেরিয়েছে। জমির অভাবে এখনো আলোর মুখ দেখেনি দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ। এতে করে বিভাগীয় নগরী রংপুরে পরিকল্পিতভাবে শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। হোঁচট খেতে হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের।

প্লট বরাদ্দ কমিটি ও উদ্যোক্তাদের দাবি, রংপুরে বিসিকের অধীনে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জমির অভাবে দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের আবেদন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকায় যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এতে প্রতিনিয়ত কৃষিজমির ওপর চাপ বাড়ছে। বিসিক ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নতুন শিল্পনগরী স্থাপনের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

সরেজমিনে দেখা যায়, উন্নয়ন ও আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি রংপুর বিসিক শিল্পনগরীতে। নানা সংকটের কারণে জায়গা হচ্ছে না নতুন উদ্যোক্তাদের। ১৯৮০ সালে ২০ একর জায়গা নিয়ে রংপুর নগরীর সিও বাজার এলাকায় গড়ে ওঠে বিসিক শিল্পনগরী। এরপর তা উদ্যোক্তাদের ইজারা দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্পনগরীটিতে তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বেহাল সড়ক, ভাঙাচোরা ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, অনুন্নত অবকাঠামোসহ নানা সংকট ব্যবসায় অন্যতম বাধা। এতে মোট ৮২টি প্লট আছে। প্লটগুলোর আয়তন সর্বনিম্ন ৩ হাজার ১৫০ স্কয়ার ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার স্কয়ার ফুট। মোট শিল্প ইউনিট আছে ২৫টি। এর মধ্যে চালু আছে ২০টি ইউনিট। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পোদ্যোক্তা বাড়লেও বাড়েনি প্লটের সংখ্যা।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট না থাকায় এসব শিল্প ইউনিটকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে নিজ উদ্যোগে বর্জ্য অপসারণ করতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে কারখানা পরিচালনা ব্যয় । বিসিক শিল্পনগরীর ভেতরের সড়কগুলো খানাখন্দে ভর্তি এবং বর্ষাকালে বা সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু সমান জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে নানান সংকট ও সীমাবদ্ধতায় থাকা এই শিল্পনগরীর সংস্কার এবং বিকাশের জন্য বিভিন্ন সময়ে একগুচ্ছ পরিকল্পনা তুলে ধরা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি শিল্পনগরী সম্প্রসারণে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগেও আলো পড়েনি। 

বিসিক শিল্পনগরীতে থাকা কারখানার মালিকরা জানান, গ্যাস সংযোগ থাকলে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেত। অনেক সময় বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন বন্ধ থাকে। নতুন শিল্পনগরী হলেও নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ হবে। রংপুরের ছোট-বড় শিল্পের বিকাশের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। 

বিসিক ২০০৪ সালে নগরীর অদূরে দমদমা এবং ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনে প্রায় ৫০ একর জমি অধিগ্রহণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু সেই আবেদন আলোর মুখ আর দেখেনি। পরবর্তীতে নতুন আরেকটি এলাকায় দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। সেটি এখনো পাস হয়নি। 

এদিকে প্রতিদিনই নতুন নতুন শিল্পোদ্যোক্তারা এসে ঘুরে যাচ্ছেন প্লটের জন্য। কিন্তু তাদের প্লট দিতে পারছে না বিসিক কর্তৃপক্ষ। 

বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে বিশেষ অবদান রাখায় ২০০৯ সালে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী উদ্যোক্তা সামসী আরা জামান কলি জানান, জায়গার অভাবে তিনি চামড়া ও পাটপণ্য উৎপাদনে কোনো কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না। তিনি দ্রুত দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তুলে নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে জমি বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানান। তাহলে পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে নারীদের কর্মসংস্থানের পথ আরও সহজ হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পোদ্যোক্তা আবদুল মতিন জানান, তিনি প্লটের অভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে পারছেন না। অথচ নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হলে বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।

অন্যদিকে চেম্বার নেতৃবৃন্দের দাবি, বিসিকের দ্বিতীয় শিল্প নগরী স্থাপন কার্যক্রম সচল করা জরুরি। বিসিক শিল্পনগরীর ১ম প্লট শেষ হওয়ায় স্বভাবতই এ অঞ্চলের বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থান তৈরির চাহিদা পূরণে সমস্যা হচ্ছে।

অবিলম্বে শিল্প হাব ও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার দাবি নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের।

রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রেজাউল ইসলাম মিলন বলেন, বর্তমান শিল্পনগরী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়েছে। অবিলম্বে রংপুরে দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী তৈরি করা প্রয়োজন।

রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আকবর আলী বলেন, বিসিকের জায়গা না থাকায় যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত কৃষিজমির ওপর চাপ বাড়ছে। তাই দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরীর প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। তিনি সরকারের কাছে দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর জেলা প্রশাসন নগরীর অদূরে সদর উপজেলায় পাগলাপীর পানবাজার এলাকায় দ্বিতীয় বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনে ১০০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর বিসিকের ডিজিএম (ভারপ্রাপ্ত) এহেছানুল হক বলেন, আমরা বিসিক দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য জমির বিষয়ে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি। জেলা প্রশাসক আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখছেন। রংপুর বিসিককে সম্প্রসারণ করে সম্ভাবনাময় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা গেলে রপ্তানি আয় বাড়বে। সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি, তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর