বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন। এর মধ্যে কোনো কোনোটি কয়েক শ বছরের পুরোনো। এমনই একটি নিদর্শন রাজবাড়ী জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রাজবাড়ী বড় মসজিদ (খানকা শরীফ)। নান্দনিক এই মসজিদে প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে।

রাজবাড়ী পৌরসভার সামনে ৮৫ শতাংশ জমির ওপর রাজবাড়ীর বড় মসজিদ (খানকা শরীফ) অবস্থিত। মসজিদটি প্রতিষ্ঠার সঠিক সময় কেউ বলতে পারলেও ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে এই মসজিদটির নাম ছিল রাজবাড়ী টাউন মসজিদ। পরে আওলাদে রাসুল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ৩২তম বংশধর হজরত সৈয়দ শাহ মুরশিদ আলী আল কাদেরী ১৮৯২ সালে রাজবাড়ীতে অবস্থান নেন। তার ছোঁয়ায় এই মসজিদটি বড় মসজিদ (খানকা শরীফ) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তখন মসজিদটি দোচালা ছনের ছিল। ওই সময় মহকুমার সাব-রেজিস্ট্রার এনামুল কবিরসহ তিনজন তার কাছে মুরিদান গ্রহণ করেন। তখন থেকে ধীরে ধীরে টাউন মসজিদ থেকে রাজবাড়ী বড় মসজিদ (খানকা শরীফ) নামকরণ হয় মসজিদটির।

এরপর হজরত সৈয়দ শাহ মুরশিদ আলী আল কাদেরীর সুযোগ্য শাহজাদা হজরত সৈয়দ শাহ এরশাদ আলী আল কাদেরী এখানে আগমন করেছিলেন এবং পরে তার সুযোগ্য শাহজাদা হজরত সৈয়দ শাহ মুস্তারশীদ আলী আল কাদেরীও আগমন করেছিলেন। তার অবর্তমানে তারই সুযোগ্য শাহজাদা হজরত সৈয়দ শাহ রশিদ আলী আল কাদেরী গদ্দেনশীন হওয়ার পর পাঁচবার এখানে আগমন করেছেন। তার অবর্তমানে তার ছোট ভাইয়ের ছেলে বর্তমান সাজ্জাদানশীল হজরত সৈয়দ শাহ ইয়াসুব আলী আল কাদেরী আল বাগদাদী আল হাসানি আল হোসাইনি আল মেদিনীপুরী (আ.) এর আগমন ঘটেছে এখানে। সেই থেকে এই মসজিদ অত্র এলাকার মানুষের কাছে বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত। আওলাদে রাসুলের খানকা শরীফ হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে অগণিত ভক্তবৃন্দসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের এখানে আগমন ঘটে। বর্তমানে আঞ্জুমান-ই-কাদেরীয়া (সংগঠন) মসজিদটি পরিচালনা করে। যার সভাপতি কাজী ইরাদত আলী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল আজিজ খোকন কাদেরী। বর্তমানে সারা দেশে এর ১৮টি শাখা রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, একতলা ভবনবিশিষ্ট মসজিদটির রয়েছে সুবিশাল এক গম্বুজ। নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা নামাজের জায়গা। হুজুরা শরীফ, খানকা শরীফ, অতিথিদের থাকাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। দূরদূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী ও মুসল্লি এখানে আসেন। শুধু মুসলিম নয় বিভিন্ন ধর্মের মানুষও ভেদাভেদ ভুলে এই মসজিদে রোগবালাই থেকে মুক্তিলাভের আশায় ও বিভিন্ন কারণে মানত করতে আসেন, করেন দান-সদকা। বর্তমানে মসজিদটি সাজানো ও পরিপাটি। জেলার সবচেয়ে সুন্দর ও মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ বলেও ধারণা কাদেরীয়া তরিকার মুরিদান এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষের। এখানে একসঙ্গে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

মরিয়ম খাতুন নামের এক নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানত করেছিলাম আমার জমির ফসল নষ্ট না হলে মসজিদে চাল দেব। সেই চাল আজ দিয়ে গেলাম। আমি অনেক দিন আগে থেকেই এই মসজিদে আসা-যাওয়া করি।

মো. মহিউদ্দিন নামের স্থানীয় এক মুসল্লি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ পড়ি। সব থেকে বড় কথা এই মসজিদে এলে আমার মনে তৃপ্তি লাগে। আমার আওলাদে রাসুলের গওসপাকের কদম আছে এই মসজিদে। রাজবাড়ী জেলার সকল মানুষ এই মসজিদকে পবিত্র স্থান বলে মনে করে। 

মসজিদের অভ্যন্তরে টুপি, তসবি ও আতর বিক্রি করেন গোলাই মল্লিক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর যাবত এই মসজিদে টুপি, আতর, তসবি বিক্রি করি। এখানে অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ নামাজ পড়তে আসে। মানুষের মনের একটা আশা বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর মসজিদ, আওলাদে রাসুলের মসজিদ, এ কারণে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে নামাজ পড়তে আসেন। মসজিদ দেখে সবাই প্রশংসা করেন। এ ছাড়া অনেকে তাদের ছোট বাচ্চাকে চিনি মুখে দিতেও এই মসজিদে নিয়ে আসে।

বড় মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই মসজিদটা ঐতিহ্যবাহী বড় মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদে আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রদত্ত কিছু নেয়ামত রয়েছে। যার কারণে বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিদের আগমন ঘটে। এই মসজিদে আওলাদে রাসুলের কদম পাক আছে। 

তিনি আরও বলেন, এই মসজিদে আরও কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন : চারজন আওলাদে রাসূল এখানে আগমন করেছেন। অনেক মুসল্লি বলেন এই মসজিদে নামাজ পড়লে অন্তর শীতল হয়ে যায়, তাদের নামাজ ও ইবাদতে মনোযোগ আসে। 

মসজিদের পেশ ইমাম আলহাজ হাফেজ মো. শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজবাড়ী পৌরসভার মধ্যে এখন অনেক মসজিদ রয়েছে। তবে ব্রিটিশ আমলে এখানে মাত্র তিনটি মসজিদ ছিল। তার মধ্যে একটি হচ্ছে রাজবাড়ীর বড় মসজিদ। ১৮৯২ সালে আওলাদে রাসুলের ৩২তম পুরুষ হজরত সৈয়দ শাহ মুরশিদ আলী আল কাদেরী এখানে এসেছিলেন। তার কদম পাকের ছোঁয়া এখানে পড়েছে। তারপর থেকেই এটি বড় মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এই মসজিদে মুসল্লিদের জন্য প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের ভেতরের সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে অনেক ভালো। এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয়। প্রতি ওয়াক্তে দুই শতাধিক মুসল্লি নামাজ পড়েন। এ ছাড়া জুমার নামাজে প্রায় ১৫ শতাধিক মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন। মুসল্লিদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া মাহে রমজানে প্রতিদিন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করা হয় এবং অগণিত লোক এখানে ইফতারিতে শরিক হন। এ ছাড়া পবিত্র খতম তারাবিহ হয়। দুইজন হাফেজ সাহেব খতম তারাবির নামাজ পড়ান। এ ছাড়া কেউ বড় বিপদে পড়লে, কঠিন অসুস্থ হলে আওলাদে রাসুলের এই দরবার শরীফে এসে বিভিন্ন মানত করেন। এই জন্য মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে একটু ব্যতিক্রম ও মর্যাদাপূর্ণ বলে সবাই মনে করে।

এমজেইউ