২০২৪ সালে ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তাদের একজন ময়মনসিংহের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. হরিশংকর দাশ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি এই পদক পাচ্ছেন। শুক্রবার (১৫ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফোন করে  বিষয়টি জানানো হলে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তিনি। যদিও তিনি পরে নিশ্চিত হন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত ১০ জনের তালিকা প্রকাশের পর থেকে শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন ডা. হরিশংকর দাশ। ময়মনসিংহ নগরের চরপাড়াস্থ পারমিতা চক্ষু হাসপাতালের স্বত্বাধিকারী তিনি। 

শনিবার (১৬ মার্চ) বিকেলে তার চেম্বারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো এদিনও স্বাভাবিকভাবেই রোগী দেখছেন স্বাধীনতা পদক পাওয়া এই চিকিৎসক। ডা. হরিশংকর দাশ মনে করেন, বাংলাদেশে যারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে তাদের মূল্যায়ন হয়, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।

তিনি বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে আমি মানুষের সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। রোগী দেখাই আমার পেশা এবং নেশা। কে পয়সা দিতে পারল, কে দিতে পারল না, এটা আমি দেখি না। আমি বিনা পয়সায় অনেক রোগীর অপারেশন করে দিয়েছি। তাছাড়া অনেক গরিব রোগী, যারা ওষুধ কিনতে পারে না, তাদের আমি বিনামূল্যেও ওষুধ দিয়ে থাকি। কোনো রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় ফেরত না যায়, এটাই মূল লক্ষ্য। এভাবেই আমি চলছি, আজীবন রোগীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।

কর্মজীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন ডা. হরিশংকর দাশ। এবার স্বাধীনতা পদকের কথা শুনে তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন। ডা. হরিশংকর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রথম যখন আমাকে জানানো হলো তখন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। এটা ফেক কিনা আমি বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমার পরিচিত বন্ধু, ময়নসিংহের সাবেক ডিসি লোকমান হোসেনকে বিষয়টি জানাই। তখন উনি বললেন- এক মিনিট, আমি বিষয়টি জানাচ্ছি। তারপরেই তিনি আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, কংগ্রাচুলেশন।

তখন আমার এই অনুভূতি তৈরি হলো যে, আমি এতদিন নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেলাম। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রজ্ঞা, মেধা এবং দূরদর্শিতার মাধ্যমে এই জিনিসটি উনি বুঝতে পেরেছেন। যারা সেবা করতে পারে তাদের মূল্যায়ন উনি করতে পারেন। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী স্থাপন করেছেন। যা আমাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে।

স্বাধীনতা পদকে মনোনীত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন বিশিষ্ট এই চক্ষু চিকিৎসক। তিনি বলেন, এর আগেও আমি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে এবারের যে পুরস্কার তা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার। স্বাভাবিকভাবেই আমি উচ্ছ্বসিত আনন্দিত। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ, সাধুবাদ ও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আমি যতদিন বেঁচে থাকি এভাবেই মানুষের জন্য কাজ করে যাব।

জানা গেছে, ১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের নিকলা গোপাল গ্রামের ইন্দুভূষণ দাশ ও রেণুকা প্রভা দাশের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন ডা. হরিশংকর দাশ। তিনি নিকলা দড়িপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ১৯৬৬ সালে কালিহাতীর নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে ১৯৭৪ সালে এমবিবিএস পাস করার নিজ উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ওই বছরেই বদলি হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন। পরে সেখান থেকে ১৯৮১ সালে তাকে পদোন্নতি দিয়ে বরিশালে বদলি করা হয়। কিন্তু সেখানে তিনি যোগদান না করে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। 

পরে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ১৯৮২ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে যান ডা. হরিশংকর দাশ। সেখান থেকে তিনি চোখের চিকিৎসার ওপর ডিও এবং এম.এ.এম.এস ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ভিয়েনা থেকে ফিরে ময়মনসিংহ গিয়ে তার ছোট মেয়ে পারমিতার নামে ময়মনসিংহ চরপাড়ায় চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি চিকিৎসাসেবা দেন। এই হাসপাতালে প্রতিদিন তিনি এক ঘণ্টার জন্য ফ্রি চিকিৎসা দেন রোগীদের। এছাড়া তিনি তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রতি বছর ফ্রি ক্যাম্প করে রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দেন। ডা. হরিশংকর দাশ ভারতের মহারাষ্ট্র থেকেও চোখের চিকিৎসায় ডিগ্রি নিয়েছেন। 

উবায়দুল হক/অভিজিৎ/এএএ/আরএআর