১ কিমি দূরে সেচপাম্প থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে

আছিয়া বিবি, বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার রামেশ্বরপুর গ্রামের বাসিন্দা। বয়সের ভারে চলাফেরা কঠিন হলেও তাকে চলতে বাধ্য হতে হয় বালতি হাতে নিয়ে। কারণ, বাড়িতে সবকিছু আছে। শুধু নলকূপে পানি নেই। তাই বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয় তাকে।

এক দিন নয়, দুদিন নয়, প্রতিদিন এভাবে পানি আনতে ছুটতে হয় তাকে। শুধু আছিয়া বিবিও নন, ওই গ্রামের শতাধিক মানুষ তাদের খাওয়ার পানি আনতে এভাবেই রোজ ছুটে যান একই গ্রামের ইউসুফ হোসেনের জমির গভীর নলকূপ থেকে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানায়, এই উপজেলায় সর্বমোট সরকারি-বেসরকারি মিলে অন্তত ১৫ হাজার হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সিংহভাগ নলকূপই অচল হয়ে পড়েছে। সেগুলোতে পানি ওঠা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

উপজেলার গাড়ীদহ, খামারকান্দি, খানপুর, সীমাবাড়ী ও সুঘাট ইউনিয়নে পানির স্তর ঘরবাড়িতে থাকা হাতল নলকূপগুলোর আওতার বাইরে চলে গেছে। তাই এসব এলাকায় ঘরবাড়ির হাজার হাজার নলকূপে পানি ওঠা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

রামেশ্বরপুর গ্রামের নারী-পুরুষ সকাল হলেই কলসি, পাতিল, বালতিসহ বিভিন্ন বাসনে পানি ভরতে সারিবদ্ধভাবে যান। এরপর হাতে, কাঁধে বা ভারে সেই পানির পাত্র নিয়ে ছোটেন বাড়ির পথে। সংগ্রহ করা পানিতে চলে থালাবাসন ধোয়া, গোসল, রান্নাবান্নাসহ সব কাজ। এভাবে ওই গ্রামের মানুষের প্রতিদিন নিয়ম করে পানি আনতে হয়।

এদিকে আবার বিদ্যুৎ না থাকলে পড়তে হয় বিপাকে। কেননা, সব কাজ ফেলে তখন অতিপ্রয়োজনীয় পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ ছাড়া পানি-সংকটের কারণে বছরের এই সময়টিতে এলাকার লোকজন স্বজনদের বাড়িতে আসতে বলেন না। জামাই-মেয়েকে দাওয়াত করতে পারেন না। পানীয় জলের সংকটে তাদের আপ্যায়নে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয়। প্রতিদিন শুধু রামেশ্বরপুর গ্রামের লোকজন ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষকে ছুটতে হচ্ছে এক মেশিন থেকে আরেক মেশিনে।

শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ইফতারের আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের রামেশ্বরপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে গেলে পানি সংগ্রহের এসব দৃশ্য চোখে পড়ে।

স্থানীয়রা জানান, জানুয়ারি মাস থেকে পানির স্তর নিচে নামতে শুরু করলেও চলতি এপ্রিল মাসে এসে তা চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে শেরপুর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রামে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য হাহাকার। পানি-সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করায় গ্রামের মানুষকে পাড়ি দিতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

গাড়ীদহ ইউনিয়নের রামেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা আছিয়া বিবি, মাজেদা বেগম ও বাংড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা, শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব এলাকার অধিকাংশ এলাকার পানির স্তর ৩৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলোতে যাও ওঠে, তাতে পরিবারেরই হয় না। সেচ-সংকটের পাশাপাশি পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে বাধ্য হয়ে এসব গ্রামের লোকজন গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন।

গাড়ীদহ গ্রামের ভ্যানচালক মুক্তার হোসেন, মুদি দোকানদার আবদুর রহিম, শাফায়াত বলেন, কাজ থাকলে এখন সময় বেঁধে পানি আনতে হয় পরিবারের জন্য। সংগ্রহ করে আনা পানি দুই-তিন দিন ধরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। খাওয়ার পানির এমন সংকট গত কয়েক বছরেও হয়নি। এ ছাড়া পানি-সংকটে গরু, মহিষ, মানুষ একই ডোবা বা পুকুরে গোসল করছে। বাড়ির নলকূপে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বাড়িতে এক কিলোমিটার দূরের শ্যালোমেশিন থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

শেরপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সাহাবুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পানির স্তর ১৬ থেকে ১৮ ফুট নিচে থাকলে সেটাকে আমরা স্বাভাবিক বলে থাকি। কিন্তু ওই সব ইউনিয়নের পানির স্তর ইতোমধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ও নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় দিন দিন এসব সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নদী খনন করে এবং বিশেষ ব্যবস্থায় পানির রিজার্ভ রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

এনএ