নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। এদিকে মাহে রমজান উপলক্ষ্যে পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়াতে সবার নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে সরকারি অভিযান, বেঁধে দেওয়া পণ্যের দাম কিছুই যেন ঠেকাতে পারছে না দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন জেলার মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর। সেহরি আর ইফতারে নানা পদের আয়োজন এখন মেসের শিক্ষার্থীদের জন্য যেন বিলাসিতা। 

রাতে খাবার দিয়েই ইফতার করছেন জামালপুর জেলা শহরের বিভিন্ন মেসের শিক্ষার্থীরা। ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ অবস্থায় মাস শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ফলে বাজারের খরচে টান পড়েছে শিক্ষার্থীদের। তাই রাতের খাবার দিয়েই ইফতার সারছেন তারা। জামালপুরে বেশ কয়েকটি মেস ঘুরে ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমনি জানা গেছে।

জামালপুর জেলা শহরে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের আশপাশে গড়ে উঠেছে কয়েকটি মেস। কলেজের পাশে রঞ্জু মেসে থাকেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

গত শনিবার (১৬ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫টায় রঞ্জু মেসে গিয়ে দেখা যায়, রাতের জন্য খিচুড়ি রান্না হয়েছে। সেই খিচুড়ি দিয়েই ইফতারের আয়োজন করছেন সব শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য খাবারের বাটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই বাটিতে কিছুটা খিচুড়ি আর বয়লার মুরগির ছোট এক টুকরো মাংস। 

এই মেসের পাশেই আরও একটি মেস রয়েছে যেটির নাম রঞ্জু মেস। সেখানে ইফতারের আগে মুহূর্তে গিয়ে দেখা যায়, সব শিক্ষার্থী ইফতারের জন্য তৈরি হচ্ছে। দুইজন মুড়ি, বুন্দিয়া, আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজ-মরিচ, সরিষার তেল, অল্প পরিমাণ ছোলা দিয়ে ইফতার তৈরি করছেন। শহরের আরও কিছু ছাত্রাবাসে ঘুরে প্রায় একই চিত্র দেখা যায়।

এবারের রমজানে মেসে থাকা অধিকাংশ শিক্ষার্থী ইফতারের মেন্যুতে খেজুর, কলা, তরমুজ, পেঁপে, আনারস, বেল, আঙুর, আপেল, কমলা এ ধরনের ফল দেখেননি। ফলমূলের বাড়তি দামে ইফতার আয়োজনে ফল এখন তাদের জন্য বিলাসিতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে তাদের ইফতারের প্রয়োজনীয় আইটেম। 

ছোলা-মুড়ি, বেগুনি, বুন্দিয়া, আলুর চপ, আর এক গ্লাস শরবত দিয়ে ইফতার সারছেন মেসের শিক্ষার্থীরা

রঞ্জু মেসে থাকা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমাম হাসান বলেন, গত বছরের রমজানে আমরা কিছুদিন ভালো ইফতার করতে পেরেছিলাম। তারপর শিক্ষার্থীদের আর্থিক সংকটে ইফতার আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়। আর এ বছরের প্রথম রোজা থেকেই মেসে ইফতারের আয়োজন নেই। রাতের খাবার দিয়েই ইফতার করতে হচ্ছে। আইটেম বলতে ভাত-তরকারি কখনো খিচুড়ি করা হয়। এটি দিয়েই রাতের খাবার এবং ইফতার একসঙ্গে চলে। কষ্টের মধ্যেই এখন মেসে থাকতে হচ্ছে। কারণ এ বছর সর্বনিম্ন খেজুরের দাম ৪০০ টাকা, ছোলা-বুট-মুড়ির দামও বেড়েছে। তাই মেসের সব শিক্ষার্থীর সিদ্ধান্তে এবার মেসে ইফতারের আলাদা আয়োজন নেই।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ইফতার খুবই নিম্নমানের। গতবার যে টাকায় ইফতার করতাম সেই টাকায় এবার অর্ধেকও হয় না। কারণ সব কিছুর দাম বেড়েছে। গত বছরে আমরা ১ হাজার টাকায় ২২ জনের ইফতার কিনতাম। সেখানে বেশ কয়েক রকমের ফল থাকতো। আর এ বছরে ১ হাজার টাকা নিয়ে ফলের ধারে কাছেও পৌঁছানো যাচ্ছে না। এছাড়া ইফতার বাদে দুই বেলার খাবারেও প্রভাব পড়েছে।‌ আগের চেয়ে খাবারের মান কমেছে কারণ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা যারা মেসে থাকি সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আর মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ সময় আর্থিক অনটন লেগেই থাকে। আমরা অনেকেই টিউশনি করে মাস চালাই। এর মধ্যেই রমজানে বাজারের যে অবস্থা আমাদের ওপর খুব চাপ পড়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যও পুষ্টিকর‌ খাবার প্রয়োজন। সারাদিন রোজা শেষে ইফতারের সময় একটু ফলমূল খাব সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। আগে ইফতারে যে পুষ্টিকর খাবারগুলো খেতাম এবার সেইগুলো আর কেনা হচ্ছে না‌। রমজান মাসে আমাদের পক্ষ থেকে একটা দাবি থাকবে, শিক্ষার্থীদের জন্য রমজান মাসজুড়ে সরকারের পক্ষ থেকে অল্প টাকায় ইফতার বিক্রির ব্যবস্থা করা হলে খুব ভালো হয়।

রকিব হাসান নয়ন/আরকে