ইফতারে ফল কেনার সামর্থ্য নেই, ছোলা-বুন্দিয়াও মেসে রান্না করে খাই
আমাদের এখানে সাধারণত ইফতার করা হয় বুন্দিয়া, ছোলা (বুট), খেজুর ও শরবত দিয়ে। এর সঙ্গে দেখা যায় মাঝে মাঝে দু-একদিন নিমকি ও পেঁয়াজু থাকে। আমরা সবাই ছাত্র। পরিবার থেকে কিছু টাকা এনে আর টিউশনি করে চলি। আসলে ফল কিনে ইফতার করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। তারপরও মাঝে মধ্যে আঙুর, কলা বা আনারস আনা হয়। যদিও এগুলো নিয়মিত আনার সামর্থ্য নেই। খরচ বাঁচানোর জন্য ছোলা-বুন্দিয়াও আমরা মেসেই বানিয়ে খাই।
মেসে ইফতারের বর্ণনা দিতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জ শহরের হোসেনপুর মহল্লার মুরাদ ছাত্রাবাসে থাকা সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সেলিম রেজা।
বিজ্ঞাপন
শুধু সেলিম রেজা নয়, তার মতো প্রায় একই কথা বলছিলেন হোসেনপুর লাল মসজিদের বিপরীতে অবস্থিত মুরাদ ছাত্রাবাসের একাধিক মেস বর্ডার। এখানে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী হলেও দু-একজন রয়েছেন কর্মজীবীও। এর মধ্যে কেউ ছোট কোনো চাকরি করেন তো কেউবা আবার উদ্যোক্তা হয়ে শুরু করেছেন ছোট কোনো ব্যবসা।
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে মুরাদ ছাত্রাবাসে গিয়ে দেখা যায়, কেউ মেসের রান্নাঘরে পেঁয়াজু ভাজছেন আবার কেউবা কাটছেন পেঁয়াজ। আরেকজন মাত্রই শেষ করলেন গুড়, পানি ও সফট ড্রিংকস পাউডার দিয়ে শরবত বানানোর কাজ। মেসের একটি কক্ষের মেঝেতে আবার শরবতের পাশেই রাখা হয়েছে মুড়ি মাখানোর জন্য বড় গামলা ও ছোট একটি গামলাতে অল্প কয়েকটি খেজুর। গতকাল মেসে বানানো নিমকিরও কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে একটা পলিথিনে।
বিজ্ঞাপন
এরপর সেই বড় গামলায় একে একে নেওয়া হলো মেসেই ভাঁজা বুন্দিয়া, বুট, নিমকি ও পেঁয়াজু। এরপর পেঁয়াজ ডলে মাখিয়ে নিয়ে সেখানে মেশানো হলো মুড়ি। এরপর আজানের ধ্বনি আসতেই খেজুর, শরবত ও এগুলো দিয়ে শুরু করা হলো ইফতার।
মেসের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেসটিতে এখন মোট ১৪-১৫ জনের মতো শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী থাকেন। এর মধ্যে ১১জন প্রায় নিয়মিত মেসেই ইফতার করেন। সবমিলিয়ে রমজান মাসে ইফতারের জন্য বাজেট ধরে জমা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। যা দিয়ে চলবে ৩০ রমজানের ইফতার। দেখা যায় গড়ে একেকদিন এতোজন মিলিয়ে ইফতার বাবদ খরচের জন্য থাকে মাত্র ১৮৩ টাকা। যা জনপ্রতি হিসেব করলে বলার ভাষাও থাকে না। এটা দিয়েই কিনতে হয় ইফতারের সবকিছু। একদিন বেশি টাকা খরচ হলে পরেরদিন আবার হিসেব করে খরচ কমিয়ে আনতে হয়। সামর্থ্য না থাকায় যেন এতেই পরম তৃপ্তি খোঁজেন তারা। দেখা যায় প্রতিদিনের ইফতারের জন্য যা বরাদ্দ ধরা হয় তা দিয়ে বর্তমান বাজারে ফল কেনা সম্ভব নয়। তাই খরচ বাঁচাতে কাঁচা বুট ও তেলে ভাঁজা বুন্দিয়া কিনে মেসেই সেগুলো প্রস্তুত করা হয়। এতে অবশ্য সহযোগিতা করেন মেসের রান্নার কাজে নিয়োজিত থাকা খালা (বুয়া)।
এছাড়াও ইফতার পরে রাতের খাবার ও শেষরাতের সেহরিতেও সাধারণত থাকে না কোনো বিশেষ আয়োজন। রাতে সাধারণত ছোট কোনো মাছ ও সঙ্গে ডাল এবং সেহরিতে সাধারণত বড় কোনও মাছ (পাঙাশ, সিলভার কাপ বা রুই) আর সঙ্গে কোনো ভাঁজি। এ ছাড়া মাঝে মাঝে করা হয় ব্রয়লার মুরগির গোশত, সেটাও আবার দুই টুকরো করে। মাসে সর্বোচ্চ তিনবার কেনা হবে গরুর মাংস। এতেই যেন সুখী এই মানুষগুলো।
সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী মো. সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবাই শিক্ষার্থী বা ছোট চাকরিজীবী। এখানে এর চেয়ে বেশি কিছু আয়োজন করে ইফতার করার সামর্থ্য আসলে আমাদের নাই। আমাদের আয় নেই বললেই চলে। কেউ হয়ত টিউশনি করে, কেউবা নিজের খরচ চালানোর জন্য ছোটখাট কোনো চাকরি করে। বাকি টাকা সবার বাড়ি থেকেই আসে। যার কারণে খুব ভালোভাবে ইফতার করা আসলে আমাদের পক্ষে সম্ভব না। যার ফলে দেখা যায় যেটুকু না করলেই না সেটুকুই আমরা করে থাকি।
তিনি আরও বলেন, আমরা সাধারণত সন্ধ্যারাতে এক তরকারিই বেশি খাই। সেখানে সাধারণত ছোট মাছ থাকে, অনেক সময় সঙ্গে হয়ত একটু ভাঁজি বা ভর্তা থাকে। শেষরাতে (সেহরিতে) সাধারণত বড় মাছ খাওয়া হয়। এর সঙ্গে একটা ভাঁজি বা ভর্তা থাকে। এ ছাড়া গোশত বলতে সাধারণত ব্রয়লার মুরগি খাওয়া হয়। এর সঙ্গে অবশ্য ডাউল (ডাল) থাকে।
সিরাজগঞ্জ সরকারি ইসলামিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সাধারণত খরচ বাঁচানোর জন্য এগুলো বাজার থেকে কাঁচা অবস্থায় কিনে নিয়ে এসে এখানে রান্না করি। এতে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে এগুলো হয়ে যায়। আর এখনতো জিনিসপত্রের অনেক দাম হয়ে গেছে। আমরা চিন্তা করি, যেন অল্প খরচের মধ্যেই আমাদের সব হয়।
তিনি বলেন, বাড়ি থেকে তো আসলে সেই ভাবে টাকা পয়সা আনার সুযোগ হয় না। আমরা কেউই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান না। নিজেদের খরচটা সাধারণত নিজেরাই চালাই। যার ফলে দেখা যায় যে অনেক সমস্যার মধ্যে থেকেও আমরা এভাবেই সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করি।
ওই মেসেই থাকেন সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় রংপুর সদরের রেজাউল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখানে যারা থাকি তারা সাধারণত সবাই শিক্ষার্থী বা ছোট চাকরিজীবী। তাই আমরা ইচ্ছা করলেই ইফতারে ভালো আয়োজন করতে পারি না। আমরা সাধারণত মুড়ি, বুন্দিয়া, বুট ও স্যালাইন পানি দিয়ে ইফতার করি। ভালো কিছু খেতে মন চাইলেই পারি না। টাকা বেশি লাগে জন্য সেগুলোও বাজার থেকে কেনা হয় না, এখানেই তৈরি (প্রস্তুত) করা হয়।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মো. মনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে আর্থিক অস্বচ্ছতা ও সামর্থ্য এখানে একটা বড় বিষয়। এর পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সামাজিকতা ও অন্যের খেয়াল রাখার বিষয়টা। একদিকে যেমন মেসের শিক্ষার্থীদের মতে তাদের ভালো ইফতার করার সামর্থ্য নেই, তেমনই সমাজের যারা বিত্তশালী আছেন তারাও হয়ত ওদিকে নজর দেন না। তারা যদি ভাবেন- এই ছেলেগুলোও তো আমাদেরই সন্তান। তাদের জন্য আমাদেরও কিছু করা উচিত তাহলে অনেক ভালো হতো। এতে যেটি হতো সেটা হলো- পরবর্তী এই প্রজন্মের মধ্যে একটা চেতনা তৈরি হতো যে, বড় হয়ে দেশ ও অন্যের জন্য কিছু করতে হবে। তারাও এটাকে আরও ভালোভাবে ধারণ করা শিখতো। পাশাপাশি মেসে যারা ধনী পরিবারের সন্তানরা থাকে, যাদের সামর্থ্য আছে তাদের মধ্যেও সবাইকে নিয়ে মাঝে মধ্যে ভালো ইফতার করার মানসিকতা তৈরি হতে হবে।
এএএ