বরগুনায় তরমুজ চাষের জন্য সুপরিচিত জেলা। প্রতিবছর এ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তরমুজের চাষ বেশি হলেও গত দুই-তিন বছর থেকে বৃষ্টির পানিতে ক্ষতি ও ন্যায্যা মূল্য না পেয়ে বিকল্প ফসলের দিকে ঝুকছেন চাষিরা। তবে এবার শুরু থেকেই তরমুজের দাম অনেক বেশি হলেও চাষিরা সেই দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। জেলার আগাম তরমুজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে তরমুজ তারা ১০০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছেন একই তরমুজ বাজারে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রতি বছর সারাদেশে তরমুজের চাহিদা পূরণের একটা বড় অংশ চাষ হয় বরগুনায়। কম সময়ে অধিক লাভ ও সুমিষ্ট হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকরাই তরমুজের চাষ করেন। তবে গত দুই বছরে অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে লোকসানে পড়ে ধার দেনা ও ঋণে জর্জরিত হয়ে পরেছেন অনেক তরমুজ চাষি।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে বরগুনায় এ বছর ১৩ হাজার ৮৩৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষ হয়েছে ৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলায় ২ হাজার ৬০৫, আমতলীতে ৪ হাজার ৫৯৪, তালতলীতে ৯০৪, বেতাগীতে ২২ বামনা ১০ ও পাথরঘাটা উপজেলায় ৪২ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।

সরেজমিনে বরগুনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তরমুজ চাষে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। অনেকের আবার গাছে ফুল এসেছে ফলও ধরতে শুরু করেছে। গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এবং তরমুজের ভালো ফলন পেতে বীজ বপনের পর থেকে নিয়মিত পানি, সাড় ও কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করছেন তারা। আর এ কাজে সহযোগিতা করছেন নারী ও শিশুরাও।  

বরগুনা সদর উপজেলার ৯ নম্বর এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের মনসাতলী নামক এলাকার তরমুজ চাষি মোখলেস মৃধা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত দুই বছর আমাদের লোকসান হয়েছে। টাকার অভাবে এবার আমাদের সব জমিতে তরমুজ চাষ করতে পারিনি। গত বছর ৩ লাখ টাকা লোকসান হওয়ায় এ বছর অর্ধেক জমিতে অন্য একজনের সঙ্গে ভাগে তরমুজ চাষ করেছি। এখন গাছে ফল আসতে শুরু করেছে, যদি ফলন ভালো হয় তাহলে লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

একই এলাকার চাষি মো. আব্দুল হাকিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর সবকিছুর দাম বেশি। গত বছর যে কীটনাশক কিনেছি ৮৪০ টাকায় তা এ বছর কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪৪০ টাকা। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবার তরমুজের চাষ কমিয়ে দিয়েছি।

বরগুনার যে-সব এলাকায় আগাম তরমুজ চাষ হয়েছে সেখানে মাঠ থেকেই তরমুজ কিনে নিচ্ছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তবে তরমুজের যে চড়া দাম তা কৃষকরা পাচ্ছেন না। পাইকাররা চাষিদের কাছ থেকে অর্ধেক দামে কিনে দ্বিগুণের বেশি লাভ করছেন। তবে আগাম তরমুজের যে দাম পাচ্ছেন তাতেও চাষিদের লাভ হচ্ছে।

তরমুজ চাষি ছগির ঢাকা পোস্টকে বলেন, তরমুজ চাষ করতে আমাদের প্রায় তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। এ ছাড়া অনেক খরচ ও পরিশ্রম করতে হয়। যে দামে তরমুজ বিক্রি করি তাতে হিসেব করলে প্রতি পিস ১০০ টাকা করে দাম পাই। তবে বাজারে গিয়ে দেখি একই তরমুজ খুচরো বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। আমাদের তরমুজের ফলন ভালো হলেও সর্বোচ্চ ১০০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারি না।

মাঠের একটি বড় সাইজের তরমুজের দাম যেখানে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা সেখানে ওই বড় সাইজের একটি তরমুজ বাজারে বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। ইচ্ছে থাকলেও অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না এত দামে তরমুজ কিনে খাওয়ার। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবার ও নিম্ন আয়ের মানুষরা তরমুজ কিনতে এসে ছোট আকারের তরমুজেই চাহিদা মেটাতে হয়। তবে এসব ছোট তরমুজও কিনতে ব্যয় করতে হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। 

ক্রেতাদের সঙ্গে তরমুজের দাম নিয়ে কথা বললে আবুল কাশেম নামের এক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় সাইজের তরমুজের দাম খুবই বেশি যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। গতকাল মাঝারি আকারের একটি তরমুজ কিনেছিলাম ৩০০ টাকায়। আজকে একই সাইজের তরমুজ কিনেছি ২৫০ টাকায়। তবে বড় সইজের তরমুজের যে দাম তা সাধারণ মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব না। 

আরেক ক্রেতা তপন চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে এসে তরমুজের যে দাম দেখেছি তাতে সাধারণ মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই। যাদের বাড়তি আয় আছে তারাই কিনতে পারবেন। বাজারে যখন তরমুজ বাড়বে তখন সাধারণ মানুষ হয়ত এ তরমুজ কিনতে পারবেন।

রমজান মাসে তরমুজের চাহিদা বেশি থাকায় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী দ্বিগুণেরও বেশি লাভে তরমুজ বিক্রি করেন। আবার অনেক সময় কেউ কেউ পিস হিসেবে তরমুজ কিনে বিক্রি করছেন কেজি হিসেবে। আর এসব অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা তরমুজের বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে নিয়মিত মনিটরিং করেছেন। ফলে বাজারে তরমুজ বিক্রির শুরুতে বেশি দামে বিক্রি হলেও এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তরমুজের দাম।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. আলী আজগর সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। ৩০০ টাকার তরমুজ ৬০০ টাকা বিক্রি করায় বরগুনায় আমরা এক ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করেছি। প্রতিদিনই আমরা আমাদের এ অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

এ বছর তরমুজ চাষে বরগুনার কৃষকদের আগ্রহ কমে যাওয়ার বিষয়ে বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে গত বছর বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তরমুজ চাষে ব্যাপক বিনিয়োগ ও পরিশ্রম করতে হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষকরা এবার তরমুজের চাষ না করায় আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারিনি।

মো. আব্দুল আলীম/এএএ