রান্নার অন্যতম উপাদান মসলা জাতীয় অর্থকরী ফসল জিরা। দেশে জিরার চাহিদার পুরোটাই আমদানি হয় বিদেশ থেকে। সেই আমদানি নির্ভর ফসল দেশের মাটিতে চাষ করে রীতিমতো সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা জহুরুল ইসলাম বাদল। তার এই সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অন্য কৃষকরাও। নওগাঁ ছাড়াও সারাদেশে জিরা চাষ করা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমবে অর্থকরী এই ফসলের। এতে প্রয়োজনীয় এই মসলার দাম সহজেই হাতের নাগালে চলে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন্দর ও কাস্টমসের তথ্য মতে, দেশে চাহিদার ৬১ শতাংশ জিরা আমদানি করতে হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ৩২ শতাংশ জিরা আমদানি হয় তুরস্ক থেকে। এছাড়াও জিরা আসে মিশর, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ৩৫০ টন জিরা আমদানি হয়েছে। যার মূল্য ১২ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৯১৯ টন জিরা আমদানি হয়েছিল। যার মূল্য ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

ডলার সংকটে আমদানি নির্ভর ফসল দেশীয় বাজারে সরবরাহ করতে যখন টালমাটাল দেশের অর্থনীতি। ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষক জহুরুলের মতো চাষিদের জিরা চাষ বেশ সাড়া ফেলেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে রাণীনগর উপজেলার শিয়ালা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জহুরুলের সফলতা দেখতে প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্ত থেকে তার জমি দেখতে আসছেন শত শত কৃষক ও দর্শনার্থীরা। যারা আসছেন তাদের কেউ সতেজ জিরার সুগন্ধ নিচ্ছেন। কেউবা আবদার করছেন জিরা বীজের।

জহুরুলের জিরা খেতে দাঁড়িয়ে কথা হয় রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে আসা তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে ডিপ্লোমা করার পর সরকারি চাকরির পেছনে অনেক ছুটে ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রামে ফিরে কৃষি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জেলার মাঠ ঘুরে সফল কৃষকদের ফসল উৎপাদন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছি। এরই একটি অংশ ছিলো জহুরুলের জিরা চাষের কলাকৌশল জানা। শুরু থেকেই তার জিরার আবাদ আমি পর্যবেক্ষণ করে আসছি। এখান থেকেই বীজ সংগ্রহ করে আমিও বাণিজ্যিকভাবে জিরার আবাদ করব। এটা খুবই অল্প খরচে চাষ করা সম্ভব এবং অতি লাভজনক একটি অর্থকরী ফসল।

শিয়ালা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল বাছের, শফিকুল ইসলাম ও রিতা বেগম বলেন, জহুরুলের জমিতে জিরার বীজ বপন করার পর আমরা প্রত্যেকে তাকে নিয়ে অনেক হাসিঠাট্টা করেছি। এখানকার মাটিতে জিরা হবে তা আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি। এখন তার ক্ষেতে জিরা দৃশ্যমান। জিরা চাষের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পরার পর থেকে শত শত মানুষ তার এই জিরা দেখতে আসছেন। আমরা জহুরুলকে দেখে অনুপ্রাণিত। কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে পুরো গ্রামেই জিরার আবাদ ছড়িয়ে দিতে চাই।

কৃষি উদ্যোক্তা জহুরুল ইসলাম বাদল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিত্য নতুন ফসল উৎপাদন করে এক ধরনের আনন্দ পাই। এর আগে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে সফল হয়েছি। তবে বাজারে জিরার দাম বেশি হওয়ায় জিরা চাষে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে ইউটিউবে জিরা চাষের পদ্ধতি দেখে অনলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানিকৃত জিরার বীজ সংগ্রহ করি। এরপর ৮ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলক জিরা বীজ বপন করেছিলাম।

তিনি বলেন, জিরা চাষের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই আড়াই মাসে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকা। বর্তমানে গাছে ফুল আসার পর জিরা দৃশ্যমান হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই এসব জিরা ঘরে তুলতে পারবো। এখানে ১২-১৫ কেজি জিরা উৎপাদিত হবে বলে আমি আশাবাদী। যেখানে সব খরচ বাদে অন্তত ১৩ হাজার টাকা লাভ হবে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে জিরা লাভজনক।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর জেলায় দুজন কৃষক জিরা চাষ করেছেন। এর মধ্যে জহুরুলের সাফল্য চারদিক ছড়িয়ে পড়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। বিষয়টিকে আমরাও ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। সাধারণ ধনিয়ার মতোই স্বল্প খরচে জিরা চাষ সম্ভব। এটি চাষাবাদে খুব বেশি কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতার প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, এবার জেলায় যে পরিমাণ জিরা উৎপাদিত হবে তার বীজ সংগ্রহ করে আগামী বছর এটি সম্প্রসারিত করা হবে। এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ আগ্রহী চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা করবে। অর্থকরী এই ফসল বাণিজ্যিকভাবে দেশের মাটিতে চাষ করা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে। দামও হাতের নাগালে চলে আসবে। 

আরএআর