মুসলিম সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন নোয়াখালীর ‘বজরা শাহী মসজিদ’। প্রায় ৩০০ বছর আগের এ মসজিদের নির্মাণশৈলী এখনো বিমোহিত করে চলেছে। নোয়াখালীসহ সমগ্র বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে রয়েছে এর ঐতিহাসিক অবদান।

নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বজরা নামক স্থানে প্রধান সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে বিখ্যাত এই বজরা শাহী জামে মসজিদ অবস্থিত।

জানা যায়, দিল্লীর মোগল সম্রাটরা অবিভক্ত ভারতবর্ষে ৩০০ বছরের অধিককাল রাজত্ব করেন। দীর্ঘ এই সময়কালে মোগল সম্রাট এবং তাদের উচ্চপদস্থ আমলারা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ইমারত ও মসজিদ নির্মাণ করেন যা আজও স্থাপত্য শিল্পের বিরল ও উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিরাজমান।

এগুলোর মধ্যে আগ্রার তাজমহল, সেকেন্দ্রা, দেওয়ানে আম, আগ্রার দুর্গ, দিল্লীর লাল কেল্লা ও দিল্লির শাহী জামে মসজিদ অন্যতম। দিল্লীর বিখ্যাত জামে মসজিদের অনুকরণে মোগল জমিদার আমান উল্লাহ খান ১১৫৪ হিজরি, ১১৩৯ বাংলা মোতাবেক ১৭৪১ সালে অর্থাৎ প্রায় তিনশ বছর আগে বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন যা আজও মোগল স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে।

জমিদার আমান উল্যাহ তার বাড়ির সম্মুখে ৩০ একর জমির ওপর উঁচু পাড়যুক্ত একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। এ দিঘীর পশ্চিম পাড়ে মনোরম পরিবেশে আকর্ষণীয় তোরণ বিশিষ্ট প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং প্রায় ২০ ফুট উঁচু তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে ভীত তৈরি করা হয়। সুদৃশ্য মার্বেল পাথর দ্বারা গম্বুজগুলো সুশোভিত করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ধনুকাকৃতি দরজা। মসজিদের প্রবেশপথের ওপর রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। কেবলা দেওয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিহরাব রয়েছে।

মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের বিশেষ অনুরোধে পবিত্র মক্কা শরীফের বাসিন্দা তৎকালীন অন্যতম বুজুর্গ আলেম হজরত মাওলানা শাহ আবু সিদ্দিকী এ ঐতিহাসিক মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন। তার বংশধররা যোগ্যতা অনুসারে আজও এ মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে প্রথম ইমাম সাহেবের সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দিকী উক্ত মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

জানা যায়, অগণিত মানুষ প্রতিদিন এ মসজিদে টাকাপয়সা দান করেন। এ ছাড়া বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন।

চাটখিল উপজেলা থেকে নামাজ আদায় করতে আসা মো. শরীফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাটখিল থেকে তিন বন্ধু বজরা শাহী মসজিদে এসেছি। এই ঐতিহাসিক মসজিদের কথা সবার কাছে শুনি। এখানে এসে নামাজ পড়েছি। খুবই ভালো লাগল। আসলেই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।

মসজিদটিতে প্রায় ৫০ বছর ধরে নামাজ আদায় করেন মুসল্লি আবদুস সাত্তার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বুজুর্গি মসজিদ হিসেবে অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসে এই মসজিদে। তারা দান-সদকাহ করেন। প্রতি জুমায় প্রায় লাখ টাকার উপর দান করে সাধারণ মানুষজন। এ ছাড়া শবে বরাত, শবে মেরাজ ও শবে কদরে বেশি দান করে। দানবাক্স দুইবার খোলা লাগে। এলাকার মানুষ চায় মসজিদটির পরিবেশ যেন সুন্দর হয়।

মসজিদের পাঞ্জেগানা ইমাম হাসান সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতিহাস থেকে জানা যায় মোগল সম্রাট আকবরের বংশধর মিয়াম্বর শাহ দিল্লীর শাহী পরিবার থেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে নৌপথে অনেক অঞ্চল ঘুরে অবশেষে বর্তমান বজরা গ্রামে এসে পৌঁছান বজরী নামের বড় নৌকা নিয়ে। আর এ বজরী নিয়েই অনেক দিন এখানে অবস্থান করেন, পরবর্তীতে এলাকার নাম রাখা হয় বজরা। মোগল বাদশাহ মোহাম্মদ শাহের রাজত্বকালে বজরার জায়গীরদার পারস্য দেশীয় পীর মিয়া আম্বর শাহের নির্দেশে আমানুল্লাহ ও ছানাউল্যা ৩০ একর জমিতে একটি দীঘি খনন করেন। দিঘির পশ্চিমপাড়ে দিল্লির শাহী জামে মসজিদের অনুকরণে ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে ২৬ বছর। বর্তমানে এই মসজিদটি বজরা শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হলে দিল্লীর শাহেন শাহ বাদশা মোহাম্মদ শাহ মক্কা শরিফের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর সুযোগ্য বংশধর দিল্লির বাসিন্দা বুজুর্গ আলেমে দ্বীন হজরতুল আল্লামা শাহ সুফী হজরত মাওলানা মোহাম্মদ আবু ছিদ্দিকী সাহেবকে ইমাম ও খতিব এবং হজরত আল্লামা মীর সৈয়দ ইমাম উদ্দিন সাহেবকে মুয়াজ্জিন পদে নিয়োগ দিয়ে বজরা পাঠান।

তিনি আরও বলেন, চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মসজিদটির প্রবেশ করার পথটি পূর্বদিকে। আয়তাকার মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। মসজিদের পূর্বে তিনটি, উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি দরজা রয়েছে। মসজিদের পূর্বদিকের মধ্যের দরজায় একটি ফারসি ফলকে এর নির্মাণকাল ও নির্মাতার নাম লেখা রয়েছে। মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব অত্যন্ত কারুকার্যময়। মসজিদের চারকোণে চারটি সুন্দর মিনার রয়েছে যা এর সৌন্দর্যকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণে মোগল স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়। মসজিদের পূর্বদিকে আছে বিরাট তোরণ। তোরণের দোতলার ওপরে রয়েছে মনোরম উঁচু মিনার। এর সৌন্দর্য ও অলংকরণের জন্য চীন দেশীয় গ্লাস কেটে মসজিদের গায়ে লাগানো হয়।

মসজিদটিতে প্রায় দুই হাজারের বেশি মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন উল্লেখ করে ইমাম হাসান সিদ্দিকী বলেন, মূল মসজিদটিকে ঠিক রেখে পার্শ্ববর্তী একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যার নিচ তলায় মহিলারা এবং দ্বিতীয় তলায় পুরুষরা নামাজ আদায় করেন। মসজিদে এসিসহ আরও কিছু নির্মাণকাজ বাকি রয়েছে। বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এসব কাজ দ্রুত হবে বলে আশা করি। বজরা শাহী মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতি করেন খতিব মাওলানা মো. মীর আবুল কাশেম। মুয়াজ্জিনসহ খাদেম রয়েছেন এই মসজিদের জন্য। মসজিদটিতে প্রায় দুই হাজারের বেশি মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (বজরা হাসপাতাল) সম্মুখ থেকে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তাটি সরু হওয়ায় মানুষের যাতায়াতে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে অসুবিধার মধ্যে পড়েন।

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বজরা শাহী মসজিদ মোগল আমলের ঐতিহ্য। অনেকে এর স্থাপত্যশৈলী দেখতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন। আমরা স্থানীয়ভাবে দুই তলাবিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেছি। মহিলারা যেন নামাজ আদায় করতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছি। প্রচুর পর্যটক সেখানে দেখতে যায় তবে রাস্তা সরু হওয়ায় তাদের অসুবিধা হয়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। নোয়াখালী প্রাচীন জেলা, তাই এর প্রাচীন স্থাপনাগুলো দেখতে মানুষ এই জেলায় আসে। বজরা শাহী মসজিদকে দৃষ্টিনন্দন রাখতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। বর্ষাকালে মসজিদের সামনে নিচু জমিতে প্লাবিত হয়ে বিশাল দিঘীতে পরিণত হয়। সেখানে পর্যটকদের জন্য স্থানীয় উদ্যোগে বোট দিয়ে কিছু করা যায় কি না আমরা ভাবছি।

কীভাবে যাবেন

নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী থেকে সোনাইমুড়ীগামী যেকোনো লোকাল বাস সার্ভিস, সিএনজি, অটোরিকশায় সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (বজরা হাসপাতাল) সম্মুখে নেমে রিকশা বা পায়ে হেঁটে ২০০ গজ পশ্চিমে গেলে বজরা শাহী মসজিদে পৌঁছানো যাবে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে নোয়াখালী সদরে যাওয়ার পথে সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (বজরা হাসপাতাল) সম্মুখে নেমে পায়ে হেঁটে অথবা রিকশায় করে কয়েক মিনিটে চলে যেতে পারবেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিতে।

এমজেইউ