কেউ ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, কেউ ছিলেন গাড়ি চালক, কেউ বা ছিলেন জন্ম থেকেই এতিম, কেউবা নিজ হাতে সংসার সামলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ছেলেমেয়েদের। কিন্তু শেষ জীবনে এসে সংসারে জায়গা হয়নি। বয়স এবং ভাগ্য তাদেরকে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। এরা সবাই এখন শান্তিনিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) বাসিন্দা। নিজের সংসার ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যক্তিদের নিয়ে জীবন সায়াহ্নে তারা যেন নতুন একটি সংসার গড়েছেন। 

ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা মহল্লার সোহরাওয়ার্দী লেকপাড়ের পশ্চিমে মুজিব সড়ক সংলগ্ন এলাকায় এই শান্তিনিবাসটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ২৮ আগস্ট। এটি পরিচালিত হচ্ছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ৫০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এ শান্তিনিবাসে বর্তমানে নিবাসীর সংখ্যা ১৯ জন। এর মধ্যে ১২ জন নারী ও সাতজন পুরুষ।

গত রোববার (১৭ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শান্তিনিবাসে গিয়ে দেখা যায়, এর প্রধান ফটকে বড় একটি তালা ঝুলছে। সেখানে কেচিগেটের সঙ্গে মুখ ঠেকিয়ে সামনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শান্তিনিবাসের নিবাসী নূর জাহান বেগম (৫৮)। সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল, মানুষের হাঁটাচলা লক্ষ্য করছেন তিনি। হয়তো এভাবেই তিনি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তার শৈশব, কৈশোর আর সংসারের দিনগুলো। 

ওই শান্তিনিবাসের কারিগরি প্রশিক্ষক ডলি রানী সাহাকে ফোন করা হলে একটু পরে নিবাসের গেটের তালা খুলে দেন এক কর্মচারী। আসেন ডলি রানী সাহা নিজেও।

ডলি রানী সাহা জানান, নিবাসে কর্মচারীর সংখ্যা অপ্রতুল। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কে কখন চোখের নিমিষে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান এই ভেবে মূল ফটকে এ তালা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, একতলা বিশিষ্ট দুটি সেমিপাকা ঘরের একটিতে পুরুষ নিবাসী ও অপরটিতে নারী নিবাসীরা রয়েছেন। মেঝেতে টাইলস লাগানো এসব ঘর বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দুটি ঘরেই একটি করে এলইডি টিভি চলছে। রিমোট দিয়ে ইচ্ছেমতো চ্যানেল পরিবর্তন করে তারা পছন্দের চ্যানেল দেখছেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পুরুষদের ঘরের টিভিতে একটি বেসরকারি চ্যানেলের খবর ও নারীদের ঘরের টিভিতে ভারতীয় একটি চ্যানেলে সিনেমা চলছিল।

সেখানেই কথা হয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। এই রোজায় নিবাসীদের ইফতার হিসেবে ছোলা, মুড়ি, চিড়া, কলা, শরবত দেওয়া হয়। তবে প্রতিদিনের মেন্যু এক রকম থাকে না। তালিকা অনুযায়ী পাল্টে দেওয়া হয়।

সেহরি ও ইফতারের পরে রাতে খাওয়ার জন্য মাংস, মাছ ও সবজির যে কোনো পদ থাকে। যারা বয়সের কারণে বা শারীরিক অসুস্থতার জন্য রোজা রাখতে পারেন না তাদেরকে সকালে ও দুপুরে সবজি বা মাছ-মাংস দেওয়া হয়। রান্না করা খাবার ও ওষুধও দেওয়া হয় বিনামূল্যে। যারা ওষুধ দেখে খেতে পারেন না তাদেরকে শান্তিনিবাসের কর্মীরাই ওষুধপত্র খাইয়ে দেন। নিবাসীদের গোসলের জন্য তাৎক্ষণিক পানি গরম করতে রয়েছে গিজারের ব্যবস্থা।

নিবাসীরা ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে না ’, ‘খুব ভালো আছি’- এই কথা বললেও তাদের চোখ মুখ দেখে মনের ভেতর  জমে থাকা পরিবারের সঙ্গে জীবনের শেষ সময়টা কাটাতে না পারা, পরিবারের মায়া-মমতা না পাওয়ার একটা তীব্র হতাশাবোধ দেখা যায়। এরই বহিঃপ্রকাশ হয়তো ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে না ‘, ‘খুব ভালো আছি’ বাক্যগুলোর মাধ্যমে।

শান্তিনিবাসের বাসিন্দা জরিনা বেগম (৭৩) বলেন, আমার ছেলেমেয়ে থাকতেও নেই। ২০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। তখন বৃদ্ধাশ্রমে (শান্তিনিবাস) আইলাম না। জীবনের পরিণতি দেখেন এই শেষ সময়ে আমার ছেলেমেয়েদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেলাম, সমস্যা হয়ে গেলাম। গত এক বছর আগে তারা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে শান্তিতে আছে, আমার খোঁজখবরও নেয় না তারা।

তিনি বলেন, মাঝে মাঝে এই করিডোরে একা একা বসে কান্দি আর আল্লারে কই, ‘আল্লা আমার কপালে এই ছিল? এই রাখছিলা আমার কপালে।’

গত ৬ বছর ধরে শান্তিনিবাসে আছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত সাজ্জাদ হোসেন (৮৩)। তিনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। এরপর ৩৬ বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির গাড়ি চালিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার জন্ম ও দাদা-নানা বাড়ি সিলেটে হলেও বাবার চাকরির সুবাদে ফরিদপুরেই বড় হয়েছি। পড়াশোনা করেছি ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। নিজের আয়ে দুইটা বাড়িও করেছি। কিন্তু শেষ বয়সে আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকা হলো না। আমার ওই বাড়ি দুইটাসহ সব সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের অধিকার মতো ভাগ করে লিখে দিয়ে আমি এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছি।

সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ছেলেমেয়েদের খুব করে বললে হয়তো ওরা আমাকে এখান থেকে নিয়ে ওদের বাড়িতে রাখবে। কিন্তু আমি কারও বোঝা হতে চাইনি বলেই এখানে আছি।  এখানে নাই শুধু একটা সিংহাসন আর মাথার মুকুট। নইলে আমি বাংলার নবাব ছিলাম।

শান্তিনিবাসের বাসিন্দা ময়না বেগম (৭৩) বলেন, এই পৃথিবীতে আমার কেউই নেই। আমি বড় হতভাগা। পৃথিবীর কোনো মানুষের ভালোবাসা আমার ভাগ্যে জোটেনি। মা, ভাই-বোন কাউকে জন্মের পরে দেখিনি। ছোটবেলায় ১০-১২ বছর বয়সে বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। এক বছর পর সেই সংসার ছেড়ে চলে আসতে হয় আমাকে। এর ভেতর বাবা মারা যান। এরপর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে খেয়েছি। বয়স হওয়ার কারণে কাজ তেমন একটা না পারায় কেউ কাজে নিত না। এজন্য গত আট বছর ধরে এখানেই আছি।

শান্তিনিবাসের কারিগরি প্রশিক্ষক ডলি রানী সাহা বলেন, আমাদের এই শান্তিনিবাসে জনবল সংকট রয়েছে। সম্প্রতি ২ জন আয়া অবসরে চলে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।

তিনি বলেন, এসব সংকটেও আমরা চেষ্টা করি শেষ বয়সে একটু সুখের আশায় আসা মানুষের সর্বোচ্চ সেবা করতে। নিয়মিত ওষুধ, খাবার-দাবারের পাশাপাশি বিশেষ দিনগুলোতে ভালো খাবার খেতে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে উপলক্ষ্যে নিবাসীদের খাবার হিসেবে ইফতারের পর মুরগির তেহারি দেওয়া হয়েছে।

জহির হোসান/আরএআর