মৌসুমের রসালো ফল তরমুজ বাজারে উঠতে শুরু করেছে। সপ্তাহখানেক আগেও আগাম জাতের অপরিপক্ব তরমুজে বাজার সয়লাব থাকলেও এবার সুস্বাদু জাতের তরমুজ কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। ভালো দামও পাচ্ছেন বাজারে। আকস্মিক ঝড়-বন্যা না হলে এই মৌসুমে দ্বিগুণ লাভের আশা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে ব্যবসায়ী ও আড়তদাররাও আছেন ফুরফুরে মেজাজে। তবে খুচরা পর্যায়ে এখনো মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের নাগালে আসেনি তরমুজের দাম।

বিভাগের সবচেয়ে বড় তরমুজের বাজার বরিশাল পোর্ট রোডে বিভাগের সব জেলা থেকেই তরমুজ নিয়ে আসেন চাষিরা। এখানে কুষ্টিয়া, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারী ক্রেতারা আসেন চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি তরমুজ কিনতে। রোববার (২৪ মার্চ) ও সোমবার (২৫ মার্চ) বরিশাল পোর্ট রোড তরমুজের মোকামসহ রূপাতলী, বাংলাবাজার, নতুনবাজার এবং শহর লাগোয়া বাবুগঞ্জ, সদর উপজেলার সাহেবেরহাট, রায়পাশা-কড়াপুর, কর্নকাঠি ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ি বরিশাল থেকে জানা গেছে, গত মৌসুমের চেয়ে এই মৌসুমে ১৪ শতাংশ বেশি তরমুজ আবাদ হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৬ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৬৪ হাজার ১৮৩ হেক্টরে। উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ২৪ হাজার ৩৩০ টন। আর চলতি মৌসুমে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বিভাগের ছয় জেলায় ৫৪ হাজার ২ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। যা গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি।

বরিশালে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াই ৯৯৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। পিরোজপুরে ১২০ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত চাষ হয়েছে ১৮ হেক্টরে। ঝালকাঠিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হেক্টর। চাষ হয়েছে ৪০ হেক্টরে। পটুয়াখালীতে লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ৭৪৫ হেক্টরের বিপরীতে চাষ হয়েছে ১ হাজার ৯৫৬ হেক্টরে। বরগুনা জেলায় ১৩ হাজার ৮৩৮ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চাষ হয়েছে ৬১৫ হেক্টরে। ভোলায় ১১ হাজার ২৪৯ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে। বিভাগে সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে ভোলা ও পটুয়াখালীতে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলা থেকে দুই হাজার পিস তরমুজ বোঝাই ট্রলার নিয়ে এসেছেন মো. সোহেল। তিনি বলেন, গত বছর লাভবান হওয়ায় এবার চাষের জমির পরিমাণ বাড়িয়েছি। গত বছর ছয় কানি (৬ কানি সমান ১ হেক্টর) জমিতে তরমুজ চাষ করি ৯ লাখ টাকা খরচ করে। ওই বছর ১১ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করি। এ বছর ১০ কানি জমিতে আবাদ করেছি। আজকে যে ২০০০ পিস নিয়ে এসেছি তা প্রতি পিস ১৭৫ টাকা করে সাড়ে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছি।

ইমন ফ্রুটসের আড়তদার ইমন বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। গত বছর বৃষ্টির কারণে চাষিরা ভালো দাম পাননি। এক সপ্তাহ আগে যে তরমুজ বাজারে উঠেছিল তা অপরিপক্ব ছিল। ওই তরমুজের দামও বেশি ছিল। বিক্রেতারা হয়তো তখন লাভ করেছে তবে ক্রেতারা ঠকেছে। এখন বাজারে মৌসুমের আসল পাকা তরমুজ এসেছে। এই তরমুজের দাম সহনীয় মাত্রায় আছে।

তিনি বলেন, তরমুজের দাম বাড়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে এটি পচনশীল ফল। আজকে যে চাষি তরমুজ নিয়ে আড়তে এসেছেন, আসতে আসতে তার এক-দেড়শ তরমুজ পচে গেছে। আবার আড়ত থেকে যে ক্রেতা কিনে নিয়ে যাবেন তারও এমন দেড়-দুইশ তরমুজ পঁচে যাবে। সেই দামটি অবশিষ্ট তরমুজের সাথে যুক্ত হবে।

ইমন বলেন, আমরা পিস হিসেবে ক্রয়-বিক্রয় করি। আজকে যে দুই হাজার তরমুজ ১৭৫ টাকা দরে কিনেছি তার মধ্যে ১৫ কেজির তরমুজের পিসের দামও ১৭৫ টাকা আর ৫ কেজির তরমুজের দামও ১৭৫ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা হয়তো এসব তরমুজ নিয়ে ক্রেতা ঠকায়। কিন্তু তরমুজ সব সময়ই গড় হিসেবে বেচাকেনা হয়।

বগুড়া থেকে আসা পাইকারী ব্যবসায়ী ওসমান আলী বলেন, এখান থেকে ট্রলার ভর্তি তরমুজ পিস হিসেবে কিনে বগুড়ায় নিয়ে কেজি হিসেবে বিক্রি করব। নয়তো আমাদের লাভ হবে না। ওখানে ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করবো।

পিস হিসেবে কিনে কেজি দরে কেন বিক্রি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে ক্রেতারাই কেজিতে কিনতে চায়।

দত্ত বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী গণেশ দত্ত বলেন, আমরা পিস হিসেবে পাইকারী দামে কিনে পিস হিসেবেই বিক্রি করি। কিন্তু কিছু খুচরা বিক্রেতা আছেন যারা অল্প পুঁজিতে বেশি লাভবান হতে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতায় নামেন। তারা ক্ষেত্রবিশেষে কেজি দরে বিক্রি করে অল্পতেই অনেক টাকার মালিক হতে চান। ব্যবসায় আসলে এমন আচরণ করা উচিত নয়।

কবি জীবনানন্দ দাশ সড়কের বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, সব জায়গায় শুনি তরমুজ একেবারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এসে দেখি আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ছোট এক-একটা তরমুজ দুই থেকে আড়াইশ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

আরেক বাসিন্দা রাজু আহম্মেদ বলেন, তরমুজের বর্তমান যা দাম তা এখনো সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। বড়লোকেরা সহজেই কিনতে পারছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত কিনতে পারছে না। মূল ঝামেলা তৈরি করে খুচরা বিক্রেতারা। তারা পাইকারী কিনে এনে আকার, আকৃতি বিভিন্ন অজুহাতে যে যার মতো করে দাম নিচ্ছে। যে কারণে ১৪০ টাকায় কিনে আনা তরমুজ ভোক্তা পর্যায়ে আসতে গিয়ে ৬০০-৭০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল খামার বাড়ির অতিরিক্ত উপ-পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত তরমুজ একটি অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছরই তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। বিভাগের মধ্যে ভোলা আর পটুয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি তরমুজ উৎপাদিত হয়। বরিশাল জেলায় বিশেষ লক্ষ্যমাত্রা না থাকলেও এ বছর ৯৯৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। এখন পর্যন্ত যতদূর জেনেছি কৃষক ভালো ফলন পেয়েছেন। পাশাপাশি বাজারে ভালো দাম থাকায় বেশ লাভবান হচ্ছেন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর