চার বছর বয়সী আমির হামজা। যে শৈশব পরিবারের সান্নিধ্যে কাটানোর কথা, সেই বয়সে তার জীবন কাটছে এক এতিমখানার চার দেওয়ালের মধ্যে। যেখানে কখনো ঘুমের ঘোরে ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙলে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরার কেউ নেই। 

বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলে আমিরের চোখ ছল ছল করে ওঠে। ভাঙা ভাঙা শব্দে জানায়, দিন মজুর বাবা বেঁচে থাকতে ভালোই চলছিল তাদের তিনজনের সংসার। কিন্তু তার বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন মাছ ধরতে সাগরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি বাবা। অভাব নেমে আসে সংসারে। একাকী মা সংসার চালাতে না পেরে তাকে এতিমখানায় ভর্তি করে দিয়ে যায়। তারপর থেকে এই মাদরাসাতেই তিনি বেড়ে উঠছে। দুই চোখে বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিরাতে ঘুমাতে যায় সে।

শুধু আমির হামজা নয় বাগেহাটের রামপাল উপজেলার একুববারিয়া মধ্যেপাড়া গ্রামে অবস্থিত একটি এতিমখানায় বেড়ে উঠছে তাদের মতো আরও ২২ জন এতিম শিশু। কারো বাবা নেই তো কারো নেই মা। কেউ আবার হারিয়েছে উভয়কেই। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে এই শিশুরা উঠে এলেও সবার জীবনের গল্প এক রেখায় মিলিত।

পবিত্র রমজানে শিক্ষার্থীদের খবর নিতে এই এতিমখানায় যান ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধিরা। জোহরের নামাজ শেষে দেখা যায়, মাদরাসায় আরবি পড়তে ব্যস্ত ছাত্ররা। এরপর এখানে পর্যায়ক্রমে পড়ানো হবে বাংলা ইংরেজি, অংক, সাধারণ বিজ্ঞান। আসরের নামাজ শেষ করে মাদরাসার মাঠে খেলাধুলা করে সময় করেছিল তারা। খেলাধুলা শেষ করে ওযু করে ইফতারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে তারা। প্রতিদিন ইফতার আসে পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে। একেক দিন এলাকার বিভিন্ন মানুষ নানা পদের ইফতার সামগ্রী দিয়ে থাকে এই মসজিদে। কখনও চিড়া, খেজুর, ছোলা আবার কখনও খিচুড়ি, তেহেরি দিয়ে ইফতার করে বাচ্চারা। গত বৃহস্পতিবার ছিল খিচুড়ির ব্যবস্থা।

সেহরির কথা জানতে চাইলে শিশুরা বলে, অনেকেই এলাকার বিভিন্ন মানুষের বাসায় গিয়ে খেয়ে আসে। তারাবির নামাজ  শেষে তারা খাবার এনে রাখে মাদরাসায় এভাবে চলে তাদের জীবন।

ছয় বছর বয়সী রমজান কাজী বলে, আমার মা নেই। মারা গেছে দুই বছর আগে। তার পর বাবা আএকটা বিয়ে করেছে। সেই মা আমাকে দেখতে পারে না আমাকে মারধর করে। তাই বাবা আমাকে এতিমখানায় দিয়ে গেছে। আমি এতিমদের সঙ্গে বড় হচ্ছি ।  আপনারা দোয়া করবেন আমি যেন একদিন হাফেজ হতে পারি।  

ছাত্র আনোয়ার বলেন, এই মাদরাসার ৫০ জন ছাত্রের মাঝে সব থেকে বড় আমি। এখানে সব এতিমদের সঙ্গে আমি সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে থাকি। সব সহপাঠীদের নিজের ভাইয়ের মত জানি। মাঝে মাঝে ওদের কথা ভেবে আমার খারাপ লাগে অনেকের পরিবার থেকে কোনো খোঁজ খবর নেয় না। এইখানে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু সব কিছু কর্তৃপক্ষ বহন করে।

স্থানীয় এলাকায় শেখ নূর ইসলাম বলেন, এক যুগেরও বেশি আমার  বাসায় একজন করে লজিং রাখি। কয়েকজন এতিম  ছাত্র  আমার বাড়িতে খেয়ে হাফেজ হয়েছে। মাদরাসা যতদিন চলবে ততদিন আমার বাড়িতে লজিং থাকার সুযোগ থাকিবে।

মাদরাসার দায়িত্বে থাকা হাফেজ মাওলানা আবু হাসান শেখ বলেন, এই মাদরাসায় ৪৮ জন ছাত্র রয়েছে যার মধ্যে ২৬ জন রয়েছে এতিম। তাদের নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করছি। তারা যেন পরিবারের কথা মনে করে কষ্ট না পায়। তাই তাদের সব সময়ে আনন্দ বিনোদনের মধ্যে রাখা হয়। সবাই তাদের মন খুলে পড়ালেখা খেলাধুলা করে। তাদের কোনো চাপে রাখা হয় না। এরা এতিম,  অসহায়, তারা যেন কোনোভাবে পিছিয়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে আরবি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞানসহ সব ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে এখানে। এতিম ছাত্রদের পাশাপাশি অনেক এতিম ছাত্রীরাও আছে। তাদের জন্য  মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মহিলা এতিমখানার ব্যবস্থা করেছে। ঈদের পর সেখানে সব কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন পরিবার থেকে তাদের জন্য সেহরি ও ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ঈদের সময় মাদরাসা এক সপ্তাহ বন্ধ থাকে। এ সময় অনেকেই বাড়িতে যায়। যাদের বাবা-মা খোঁজ খবর রাখে না তাদের নিয়ে আমি এখানে থাকব।

শেখ আবু তালেব/আরকে