সনাতন ধর্মের লোক হয়েও রমজান মাসে রোজাদারদের ইফতার করান গাইবান্ধার সুজন প্রসাদ নামে এক হোটেল ব্যবসায়ী। এ বছর রোজা শুরু হলে প্রথম রমজান থেকেই গাইবান্ধা শহরের হকার্স মার্কেটের তার বাঙলা হোটেলে এই আয়োজন করেন তিনি। যেখানে মনের আনন্দেই প্রতিদিন ইফতার করতে আসেন স্থানীয় বাজার কিংবা দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার রোজাদাররা। 

রোজাদাররা বলছেন, রোজাদারদের জন্য  সুজন প্রসাদের এই ইফতার আয়োজন যেন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা মনে করিয়ে দেয় কবি চন্ডী দাসের অমর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। 

মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এমন আয়োজন করেছেন বলে জানান সুজন। প্রত্যেক রমজানেই এমন আয়োজন করার ইচ্ছা আছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

সরেজমিনে শহরের হকার্স মার্কেটে সুজন প্রসাদের বাঙলা হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, পড়ন্ত বিকেলে মাগরিবের আগেই টেবিলের ওপরে প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ইফতার। থালায় ইফতার হিসেবে রয়েছে, ছোলা, বুনদিয়া, পেঁয়াজু, বেগুনের চপ, আলু মিশ্রিত ডিমের চপ, ঝুড়ি (চিনি ময়দায় তৈরি এক ধরনের খাবার) ও জিলাপি। আরও রয়েছে, খেজুর, গাজর-শসা, কলা, তরমুজ, বিরিয়ানি ও বেলের শরবত।

মাগরিবের আজানের ঠিক আগ মুহূর্তেই ইফতার করতে হোটেলটিতে রোজাদারেরা আগমন করেন। কর্মব্যস্ততাও বাড়ে হোটেলের মালিক সুজন প্রসাদসহ কর্মচারীদের। এ সময় তারা মালিকের মতো কিংবা ব্যবসায়ীর মতো নয়- অতিথি আপ্যায়ণের মতো করে সমাদার করতে থাকেন রোজাদারদের।

এদিকে প্লেটে সাজানো অন্তত ১৩ ধরনের ইফতার দেখে বিনামূল্যের ইফতার সম্পর্কে অজানা নিম্নআয়ের মানুষগুলো হোটেলে ঢুকতে চান না। তাদের ধারণা, আকর্ষণীয় এসব ইফতার সামগ্রীর দাম নিশ্চিত আকাশ ছোঁয়া। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়া মানুষদের অতি বিনয়ের সঙ্গে হোটেলে ডেকে নেন সুজন প্রসাদ। 

এছাড়াও হঠাৎ ইফতারে আসা চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা উচ্চবিত্তের মানুষেরা ইফতার শেষে বিল দেওয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়। কিন্তু সুজন প্রসাদ তাদের হাসি মুখে জানিয়ে দেন এখানে ইফতারের কোনো টাকা নেওয়া হয় না। দাওয়াত রইল, প্রতিদিন এখানে এসে ইফতার করবেন।

এ সময় ইফতারে অংশ নেওয়া সদর উপজেলার তুলশীঘাট এলাকার ইজিবাইক চালক মতিন মিয়া বলেন, বিনা টাকায় এত ধরনের সুস্বাদু খাবার দিতে আমি জীবনে কোথাও দেখিনি। যা সুজন প্রসাদ খাওয়াচ্ছেন। অটোরিকশা রেখে প্রায় দিনই এখানে ইফতার করি। ইফতার শেষে সুজন প্রসাদের জন্য কল্যাণের দোয়াও করি। 

হকার্স মার্কেটের সাজু নামে এক ব্যবসায়ী  বলেন, এখানে প্রতিদিন পথচারী, এই বাজারের কিছু ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, ফুটপাতের দোকানদার এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে শহরে আসা মানুষগুলো ইফতারে অংশ নেন। আমিও প্রতিদিন এখানে ইফতার করে থাকি।

প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক জাভেদ হোসেন বলেন, সুজন প্রসাদের এমন ইফতার আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমার মনে হয়, লোক দেখাতে নয় সুজন একেবারে অন্তর থেকে পরিমাণ মতো, মানসম্মত এবং রুচিসম্মত এই ইফতার আয়োজন করে থাকেন। কেননা তার এই বিনামূল্যের ইফতারে ছোলা, বুনদিয়া, চপ, পেঁয়াজু ছাড়াও কলা, সালাদ, বিরিয়ানি এমনকি বর্তমান খেজুর এবং তরমুজও রাখেন। শুধু কী তাই? এক গ্লাস করে দেওয়া হয় বেলের শরবত। যা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন নিম্নআয়ের মানুষগুলো।

প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সভাপতি খালেদ হোসেন বলেন, সনাতন ধর্মের লোক হয়েও মুসলিম রোজাদারদের জন্য সুজন প্রসাদের এই ইফতার আয়োজন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটিই প্রমাণ করে বাংলাদেশ অসম্প্রদায়িক দেশ। সুজনের এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশে। সকল ধর্মের মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হোক।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাইতুন নূর জামে মসজিদের পেশ ইমাম আল আমিন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্য ধর্মের যে কেউ ইফতার কিংবা দান করতে পারেন, এটাতে ইসলাম ধর্মের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। সুজন প্রসাদ যে কাজটি করছেন নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো কাজ। এ কাজের জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি সাধুবাদ জানাই। সমাজে সবাই এভাবে এগিয়ে আসলে সমাজটা অনেক সুন্দর এবং ভালো হবে।

হোটেল ব্যবসায়ী সুজন প্রসাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষ হিসেবে দেশের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি আমার সাধ্য মতো, পরিমাণ মতো এবং মানসম্মত এই ইফতার আয়োজনের চেষ্টা করে থাকি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। সবার ওপরে আমরা মানুষ। একে অপরের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে। 

আরএআর