নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মালিক অসুস্থ থাকায় এজেন্ট ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে ব্যাংকটির মালিক দাবি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার হাত থেকে এজেন্ট ব্যাংকটি বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন নারী উদ্যোক্তা ও এজেন্ট ব্যাংকের মালিক সাবিনা ইয়াছমিন।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের মজুমদারহাট ব্যাংক এশিয়া এজেন্ট আউটলেট শাখার স্বত্বাধিকারী নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াছমিন নোয়াখালী সদর উপজেলার লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের সাত্তার মিয়া বাড়ির শহিদ উল্যাহ আনছারের মেয়ে। অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম দ্বীন মোহাম্মদ। তিনি নোয়াখালী সদর উপজেলার মাইজদী গ্রামের মোহাম্মদ উল্যাহর ছেলে।

জানা যায়, ২০১৮ সালে নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াছমিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নে ব্যাংক এশিয়ার একটি এজেন্ট ব্যাংক শাখা পরিচালনা শুরু করেন। সেখানকার একমাত্র এজেন্ট ব্যাংক হওয়ায় দ্রুতই এটি জনপ্রিয় ওঠে। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে নাজমা বেগম শিরীনসহ চার নারীকে যুক্ত করেন সাবিনা ইয়াছমিন। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিশ্বাস করে শিরীনের স্বামী দ্বীন মোহাম্মদকে ব্যাংক পরিচালনার (পজিটিভ পে) দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে মতের অমিল হওয়ায় সেই চার নারীকে লভ্যাংশসহ প্রদান করেন সাবিনা। দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয় দ্বীন মোহাম্মদকেও। কিন্তু প্রতারণার মাধ্যমে তখনকার স্বাক্ষরিত একটি চেক রেখে দেন দ্বীন মোহাম্মদ। ২০২৪ সালে এসে সেই চেকে ৩৫ লাখ টাকা লিখে ব্যাংকটির মালিক দাবি করছেন দ্বীন মোহাম্মদ, দিয়েছেন উকিল নোটিশও। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন জবাই করে হত্যা করবেন সাবিনাকে। বহুরুপী দ্বীন মোহাম্মদের হাত থেকে এজেন্ট ব্যাংককে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াছমিন।

সাবিনা ইয়াছমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সঙ্গে দ্বীন মোহাম্মদের কোনো লেনদেন ছিল না। তার স্ত্রী নাজমা বেগমের আমাদের ব্যাংকে শেয়ার ছিল।  আমার অসুস্থ থাকাকালীন দ্বীন মোহাম্মদ দায়িত্বে ছিল। তখন আমার স্বাক্ষরিত চেক ব্যবহার করে তিনি টাকা উত্তোলন করতেন। এক বছর আগে তার স্ত্রীর শেয়ার আমি কিনে নিয়েছি। তখন থেকে উনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার স্বাক্ষরিত কোনো চেক তার কাছে আছি কিনা। তিনি বলেছেন নাই। আমি তারপর থানায় একটা জিডি করে রেখেছি। বর্তমানে আমাকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে আমার কাছে নাকি ৩৫ লাখ টাকা পায়। আমাকে জবাই করে হত্যা করবে বলেও হুমকি দিচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, আমি একজন নারী উদ্যোক্তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেন। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রতারণার বিচার চাই। দ্বীন মোহাম্মদ আমার ব্যাংকের এবং আমার ক্ষতি করবে বলে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। সে হলো বহুরুপী প্রতারক। দায়িত্ব থাকাকালীন চেক রেখে দিয়ে সে এখন প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তার কাছে আরও চেক থাকতে পারে। আমার ব্যাংক ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা চাই।

রাজগঞ্জ ইউনিয়নের প্রবাসী রাসেল সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রবাস থেকে এজেন্ট ব্যাংকটার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করি। আমাদের বাজারের প্রথম ব্যাংক এটি। নারী উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াছমিন ব্যাংকটি এখানে আনায় আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দ্বীন মোহাম্মদ যা করছে তা খারাপ করছে। এতে করে মানুষ ব্যাংকের বিষয়ে খারাপ ধারণা নিচ্ছে এবং গ্রাহক হারাচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের নজরে আসা দরকার। তাহলে নিরাপদ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত হবে।

বিভিন্ন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ২ জুলাই থেকে পজিটিভ পে নোটিশ ফর চেক পেমেন্টের জন্য দ্বীন মোহাম্মদকে দায়িত্ব দেওয় হয়। তারপর থেকে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত সাবিনা ইয়াছমিনের স্বাক্ষরিত প্রায় দেড় শতাধিক চেক ব্যবহার করেন। তারপর সাবিনা সুস্থ হয়ে ব্যাংকে নিয়মিত দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তারপর মতের অমিল হলে ২৩ সালের ১ এপ্রিল সিদ্ধান্তক্রমে চার লাখ মূলধন আর তিন লাখ টাকা লাভ দিয়ে নাজমা বেগমের শেয়ারটি কিনে নেন সাবিনা। যার প্রমাণ হিসেবে একটি লিখিত কাগজ করা হয়। যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত উল্যাহ ও দ্বীন মোহাম্মদ সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ৩৫ লাখ টাকা পাবেন বলে সাবিনাকে একটি উকিল নোটিশ দেন দ্বীন মোহাম্মদ। 

সাবিনার দাবি, দ্বীন মোহাম্মদ দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে কৌশলে চেক রেখে দিয়েছেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত উল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, দ্বীন মোহাম্মদ কোনো টাকা পাবেন এটা আমাদের জানা ছিল না। লেনদেন ছিল দ্বীন মোহাম্মদের স্ত্রী নাজমা বেগমের সাথে। যেদিন সভা হয়েছিল সেদিন আমাদের উপস্থিতিতে দ্বীন মোহাম্মদের স্ত্রীকে লভ্যাংশসহ সাত লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে রাজগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর চৌধুরী সেলিম জানেন। কিন্তু বর্তমানে দ্বীন মোহাম্মদ নাকি ৩৫ লাখ টাকা পাবেন। এসব বিষয়ে আমরা জানতাম না। 

রাজগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর চৌধুরী সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দ্বীন মোহাম্মদের স্ত্রী সাত লাখ টাকা পেয়েছেন তা আমি জেনেছি। সেই টাকা তিনি তুলে নিয়েছেন। এটা একটা মীমাংসিত ঘটনা। হঠাৎ করে দ্বীন মোহাম্মদ এসে ৩৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা জানাচ্ছে। এসবের কিছু আমার জানা ছিল না।

নিজেকে ব্যাংকের মালিক দাবি করে দ্বীন মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্ত্রীর সঙ্গে লেনদেন ক্লিয়ার হওয়ার পর ব্যাংক একজন ক্রয় করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। তাই আমার কাছে সাবিনা ইয়াছমিন ব্যাংকটি বিক্রি করে দেন। এটা সেই চেক। আমি দায়িত্ব থাকাকালীন কোনো চেক নয়। আমি টাকা পাই তাই উকিলের মাধ্যমে নোটিশ দিয়েছি।

ব্যাংক এশিয়ার মাইজদী শাখার ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিষয়টি জানি। একটি ব্যাংক শুরু হলে কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। ফলে সাবিনা ইয়াছমিন শেয়ার নিয়েছিলেন। সেটি আবার লভ্যাংশসহ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেটেল হওয়ার পর যে কাগজপত্র হয়েছে সেখানে কিন্তু দ্বীন মোহাম্মদের স্বাক্ষর আছে। 

হাসিব আল আমিন/আরএআর