সময়টা ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট দুপুরবেলা। তখনও মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার চিথোলিয়া পাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাশের গোপালাশ্রম গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে অনেকে শহীদ হন, আহত হন আরও অনেকে। গুলিতে আহতদের একজন গোপালাশ্রম গ্রামের রাশিদা আক্তার।

একাত্তরে যুদ্ধের সময় সেই ২০ বছরের তরুণী রাশিদার বয়স এখন ৭৩ বছরের বৃদ্ধা। পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলি তার পিঠের ডান পাশে কাঁধের নিচে লাগে। সেই গুলি আর বের করা যায়নি। ৫৩ বছর ধরেই রাশিদা নিজের শরীরে সেই গুলি বহন করে চলেছেন। ফলে মাঝে মধ্যেই ভুগতে হয় অসহনীয় ব্যথায়। গুলিবিদ্ধ হবার পর ডান চোখেও ঠিকমতো দেখতে পান না তিনি। আর্থিক অসচ্ছলতায় ন্যূনতম চিকিৎসাও জুটেনি তার কপালে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শরীরের ভেতরে থাকা গুলির ধকল আর সইতে পারছেন না বলে বৃদ্ধা রাশিদা আক্তার ও তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

ওই দিনের ঘটনা জানতে চাইলে রাশিদা বলেন, ‘ওই দিন স্বামী আমার বাবার বাড়িতে ছিল। ওই দিন দুপুরবেলা গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। আমার চাচা শ্বশুর বলল, বাড়িতে থাইকো না, মনাং গ্রামে চলে যাও। বাড়ি থেকে নৌকায় যাওয়ার সময় একটা গর্তের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে বাচ্চা নিয়ে গর্তে পড়ে যাই। তখন আমার চাচা শ্বশুর হাত ধরে টাইনা আমারে উপরে ওঠায়। উঠানোর পর উনি একটা নৌকা আনলো। আমি আমার ছেলেকে নিয়া রওনা দিলাম মনাং গ্রামে যাওয়ার জন্য। সঙ্গে আমার জা, আমার চাচি শাশুড়ি আরও অনেক আছিল। নৌকায় ওঠার পর চাচা শ্বশুর নৌকা চালাচ্ছিল। হঠাৎ করে তার মাথায় একটা গুলি লাগল। গুলি লাগার পর ধপাস করে পড়ে গেলেন উনি।

হঠাৎ করে আমার পিঠে ধপাস করে কী একটা লাগলো। আমি আমার চাচি শাশুড়িকে কইলাম আমার পিঠে কী হয়েছে? তারা একটু কাপড়টা সরাইয়া দেখল গুলি লাইগা এত বড় গর্ত হইয়া গেছে। এই ঘটনা মনাং গ্রামের লোকজন আগাইয়া আইসা আমাদের নিয়ে গেল।’

‘শরীরের রক্ত সব বাইর হইয়া যাইতেছে। তখন ওই দিন সন্ধ্যায় আমারে উপজেলার আদমপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখলো ডাক্তার নাই। পরে রাতের বেলা নৌকায় করে ময়মনসিংহ হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। মাঝপথে আবার মিরিটারিরা আটকাইলে কইলাম বাবা হাত ভাংছে আর কষ্ট দিয়েন না। তারা আর কিছু কইলো না, ছাইরা দিল। তারপর ময়মনসিংহ নিয়ে গেলে ডাক্তার দেখার পর তারা কইলো এখন গুলি বের করার সুযোগ নেই, যুদ্ধের পরে করতে হবে। করলেও অপারেশন করে হাড় কাটতে হতে পারে। পরে তারা ব্যান্ডেজ কইরা ওষুধপত্র দিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। বাড়িতে আসার পর মাসখানেক পর আমার চোখের সমস্যা দেখা দিল, চোখে কম দেখি। তারপর আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম তারা দেখার পর বলল হাতের সমস্যার কারণেই চোখের সমস্যা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন এ ব্যথা নিয়াই জীবন পার করতেছি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় আর সহ্য করতে পারি না। তখন ছেলেরা ইনজেকশন করে ব্যথা কমে। তখন মনে হয় মইরা গেলেই ভালো আছিল। আর চিকিৎসা কি করমু? আমার ছেলে একলা কামাই করে। এত বড় সংসারে বাচ্চা-কাচ্চার খাওনের ব্যবস্থা করব, নাকি মায়ের লাইগা ওষুধ কিনব? এমনেই দিন যাইতেছে, এমনেই একদিন মাটির নিচে গেলেই সব শেষ। কেউ সাহায্য করে নাই আজ পর্যন্ত। কেউ করব কিনা জানিনা। যা করতাছে আমার পুতের করতাছে। ঋণ করুক যাই করুক আয়না খাওয়াইতেছে।

সরকারের কাছেও কিছু চাওয়ার নাই। একটাই কথা, তাদের যদি মনে চায় আমারে একটু টাকা-পয়সা দিয়া সহযোগিতা করুক। শেষ বয়সে একটু আরাম-আয়েশ কইরা যাইতে চাই। আর কোন চাওয়া নাই আমার। এ পর্যন্ত সরকারের দয়া লাগে নাই, আর লাগব কিনা জানি না!’

রাশিদার বড় ছেলে কাঞ্চন মিয়া ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘বর্তমান সরকার আমার মায়ের কাছে হিসেব দিতে পারবে না। সরকার মুক্তিযোদ্ধার লিস্ট বানাইছে ভালো কথা। তাহলে আমার মা যে যুদ্ধের সময় গুলি খাইলো, গুলিটা এখন পর্যন্ত ভেতরে রয়ে গেল। এটা হাতে নিয়ে এখন পর্যন্ত ঘুরে বেড়াইতেছে, তাহলে এই সরকার কি করতেছে? আমার মায়ের মুক্তিযোদ্ধার লিস্টে নাম দরকার নাই, ভাতা দরকার নাই, একটু চিকিৎসা তো দিতে পারতো আমার মাকে! কেউ তো একটু খোঁজ নিল না আমার মায়ের!’

কাঞ্চন মিয়া আরও বলেন, কিছু মানুষ খোঁজ-খবর নিছে তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। মায়েরে ভাতা দিবে, সুযোগ-সুবিধা দিবে বলে চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে গেল। তারপর শুনি তারা আমার মাকে বাদী করে মামলা করছে। আমরা এই মামলার কিছুই জানি না, কিন্তু আমার মা এই মামলার বাদী। মা চোখে দেখে না, হাতের ব্যথায় প্রায় সময় পাগলের মতো অস্থির হয়ে যায়। তার জীবন নিয়েই টানাটানি চলে সবসময়। তাইলে আমরা মামলা করে কী করমু আপনিই বলেন। সমাজের কিছু প্রভাবশালী লোক আমার মায়ের এই অসুস্থটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিলে উঠে পড়ে লেগেছে। যেটা খুবই জঘন্য কাজ বলে আমি মনে করি। শেষ কথা একটাই, আমরা গরিব মানুষ চিকিৎসা করার মতো টাকা নেই। সরকার যদি একটু আমার মায়ের জন্য সহযোগিতা করতো তাহলে আমার মা শেষ বয়সে একটু আরাম করে যেতে পারত।

রাশিদার মেয়ে রহিমা আক্তার বলেন, আমার মা সংগ্রামের সময় মিলিটারির গুলিতে আহত হইছিল। এটার যখন ব্যথা ওঠে তখন খুব কান্নাকাটি করে, যেটা আমরা সহ্য করতে পারি না। আমাদের টাকা-পয়সা নেই, আমরা চিকিৎসা করতে পারি নাই। মা এভাবেই গুলি নিয়া চলতেছে। সরকার যদি আমাদেরকে একটু সহযোগিতা কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থা করত তাহলে একটু ভালো হতো। মা একটু আরাম পাইতো।

রাশিদার ছোট ছেলে ইছহাক মিয়া বলেন, ৫৩ বছর হলো সংগ্রাম গেছে। আমার মা এখন পর্যন্ত শরীরে গুলি বহন করতেছে। আমরা যতটুক পারতেছি চেষ্টা করতেছি চিকিৎসা করার। কিন্তু চিকিৎসা করতে করতে আমরা এখন অসহায়। চিকিৎসা করার মতো অবস্থা আমাদের নেই। মাঝে মাঝে যখন বেশি ব্যথা হয় তখন একটু ওষুধপত্র আইনা দেই, খরচপাতি করি, আর কিছু পারি না। সরকার যদি একটু আমার মার দিকে নজর দিত, তাহলে মায়ের আত্মাটা শান্তি পাইতো। আমরাও শান্তি পাইতাম।

গোপালাশ্রম গ্রামের বাসিন্দা মো. আবুল হাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংগ্রাম যখন শুরু হইল তখন পাক বাহিনী আসলো গ্রামে, তখন আমি বাড়িতে আসলাম। আইসা দেখি যারা যারা দৌড়ে আমাদের বাড়িতে উঠছিল তাদের মধ্যে ৭ জন মারা গেছে। আবার অনেক মানুষ আহত হইছে। কারো হাত কাটছে, কারো পা কাটছে, কারো গুলি লাগছে। তখন আহত আমাদের এই রাশিদা ভাবি গুলিবিদ্ধ হইছিল। এত বছর ধরে গুলিটা নিয়ে কষ্ট করতেছে, আমরা দেখতেছি কিন্তু কিছু করতে পারি না।

একই গ্রামের বাসিন্দা মো. শহীদ মিয়া বলেন, জীবনের শেষ বয়সে এসেও সেদিনের ঘটনা রশিদাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। বর্তমানে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধে আহত রশিদা আক্তারের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করুক, সরকার তার দায়িত্ব নিক।

উপজেলার চিরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. রঙ্গু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি তাদের পরিবারের সবাইকে চিনি। যে মহিলার কথা বলছেন তিনি আমাদের কাঞ্চনের মা। কাঞ্চন আমার খুব কাছের একজন, ওরা সবাই খুব নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। উনি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা হামলা করলে পিঠে গুলি খান। অনেক দিন ধরে খুব কষ্ট করছেন গুলিটা নিয়ে। মাঝে মধ্যে ব্যথায় চিৎকার চেঁচামেচি করেন যেটা খুব কষ্টদায়ক। শেষ বয়সে উনি এতো কষ্ট করেন এটা মানা যায় না। উনাকে কোনোভাবে একটু সহযোগিতা করতে পারলে একটু আরাম পেতেন।

পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক আকন্দ। মুক্তিযুদ্ধে সময় ১১ নম্বর সেক্টর থেকে দেশের হয়ে যুদ্ধ করেন নেত্রকোণার কলমাকান্দা, নাজিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায়। রাশিদা আক্তারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ রাশিদার ঘটনাটা সত্য। কিন্তু ঘটনার সময় আমি এলাকায় ছিলাম না। পরে এসে জানতে পারলাম হামলার ঘটনা। সাত জন মারা যায় সেদিনের হামলায়। ওই ঘটনায় রাশিদার যে চাচা শশুর মারা যায় উনি আমার সহপাঠী ছিল। তার মাথায় গুলি লাগলে সে ওখানেই মারা যায়। তার কিছুক্ষণের মধ্যে রাশিদা আগত হন। যুদ্ধের পরে আহত অনেকের সঙ্গে দেখা হলেও রাশিদা মহিলা হওয়ায় সেভাবে দেখা হয়নি। তবে তার বিষয়ে খোঁজ খবর রেখেছি। তিনি এখনো তার শরীরে একনো সেই গুলি বহন করে আসছেন। শুনলাম প্রায় সময়ই নাকি গুলির জায়গায় প্রচুর ব্যাথা হয়। তখন নাকি পাগলের মতো অস্থির হয়ে যান। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হওয়ায় ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারে না যেটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। শেষ বয়সে তিনি একটু সুযোগ-সুবিধা পেলে হয়ত একটু শান্তিতে কয়টা দিন থাকতে পারতেন।

এ ব্যপারে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমদাদুল হক তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কিছুদিন আগে এখানে যোগদান করেছি। এ বিষয়টি আপনার মাধ্যমে আমরা প্রথম জানলাম। আমি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে দেখব উনার বিষয়টা।

চয়ন দেবনাথ/আরকে