মুসলিম স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন নওগাঁর ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদ। প্রায় ৪৬৫ বছরের এই পুরাকীর্তি পুরোটাই পাথরে মোড়ানো। দেয়াল, মিনার এবং গম্বুজে নকশা খোদায় করা। অপরূপ সৌন্দর্যের এই মসজিদটি মুসল্লিদের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের। পাঁচ টাকার কাগজের নোটে মুদ্রিত এ মসজিদটিকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইতিহাস অনুযায়ী, কুসুম্বা শাহী মসজিদের মূল স্থাপনা নির্মাণ ৯১০ হিজরিতে শুরু হয়। দীর্ঘ ৫৬ বছর পর এ মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয় ৯৬৬ হিজরিতে। অর্থাৎ ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আফগানদের শূর বংশের শেষ দিকের শাসক গিয়াস উদ্দীন বাহাদুর শাহ’র শাসনামলে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর মূল গাঁথুনি ইটের তৈরি হলেও সম্পূর্ণ দেয়াল কালো পাথরে মোড়ানো।

জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলায় অবস্থিত কুসুম্বা শাহী মসজিদে সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে প্রথমেই নজরে আসে মসজিদের দেয়ালজুড়ে থাকা প্রাচীন টেরাকোটার দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। এর মিহরাবে রয়েছে বিচিত্র ফুল, লতাপাতা, ঝুলন্ত শিকল ও মনোরম শিল্পকর্ম। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, চওড়া ৫২ ফুট। ছাদের উপর রয়েছে গোলাকৃতির মোট ছয়টি গম্বুজ।

মসজিদের ভেতরে প্রবেশের আগেই নজরে আসে মসজিদ চত্বরে রাখা বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথরের। কথিত আছে, এক কৃষক হালচাষের সময় তার জমিতে এই পাথরটি দেখতে পান। পাথরটি লাঙলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙে যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবি লিপি রয়েছে। ‘আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ।’ এ থেকে বোঝা যায় পাথরটি হুসেন শাহের স্মৃতি বিজড়িত।

প্রাচীর বেষ্টিত এ মসজিদের সামনেই রয়েছে ৭৭ বিঘা আয়তনের সুবিশাল এক দিঘী, যেটি এখন কুসুম্বা দিঘী নামে পরিচিত। কথিত আছে এ দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মে না। দীঘিতে নামার জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি রয়েছে। যেখানকার শান বাঁধানো ঘাটে ওজু করেন মুসল্লিরা। দীঘির হৃদয় শীতল করা পানিতে দর্শনার্থীরা হাত-মুখ ধুয়ে ক্লান্তি দূর করেন। স্থানীয় বাসিন্দারা এই দীঘিতে নেমে গোসলও করেন।

বর্তমানে কুসুম্বা শাহী মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদের ভেতরে প্রবেশের পরই নজরে আসে কাজী মঞ্চ। কথিত আছে- একসময় ওই আসনে বসেই বিচারকাজ পরিচালনা করতেন তৎকালীন কাজীরা। মসজিদ ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থার যাবতীয় কার্যক্রম হত এখানেই।

মুসলিম স্থাপত্যের ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি দেখতে কুসুম্বা শাহী মসজিদে প্রতিনিয়ত ভিড় জমান দূরদূরান্ত থেকে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। আবার কেউ আসেন মনোবাসনা পূরণে মানত করতেও। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার এবং বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয় কুসুম্বা শাহী মসজিদে। এ মসজিদকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে দোকানপাট।

গত ১৯ মার্চ ঢাকা থেকে কুসুম্বা শাহী মসজিদে এক জাপানি পর্যটককে ভ্রমণের জন্য এনেছিলেন জাবা ট্যুর লিমিটেডের ট্যুর অপারেটর কানন বড়ুয়া। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জাপানিদের জানার আগ্রহ অনেক বেশি। অনেক জাপানি বাংলাদেশে আসার পর ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখতে আমাদের সহযোগিতা নেন। ‘কেনজি হান্ডা’ নামের জাপানির অনেক আগ্রহ ছিল কুসুম্বা মসজিদ দেখার। তাকে পুরো মসজিদ ঘুরে দেখানোর পর সুলতানি আমলের ঐতিহাসিক এ নিদর্শন দেখে তিনি রীতিমতো অবাক হয়েছেন। মসজিদটি দেখার পর তিনি বলেছেন ‘আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে তো প্রযুক্তি এত এগিয়ে ছিল না। এরপরও কীভাবে পাথরগুলো এত সুচারুভাবে স্থাপন করা হয়েছে!’

মসজিদে মানত করতে আসা মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের মটগাড়ি গ্রামের বাসিন্দা কোহিনুর বেগম বলেন, একমাত্র মেয়ে ও নাতি দীর্ঘদিন যাবত শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তাদের সুস্থতা কামনা করে কুসুম্বা শাহী মসজিদে নামাজ আদায়ের পর মানত করলাম। তারা সুস্থ হলে এখানে হাঁস জবাই করে পোলাও রান্না করে মসজিদের মুসল্লিদের খাওয়াব। আমার বিশ্বাস এবার মেয়ে ও নাতি সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ। কারণ দীর্ঘ ২৫ বছর আগে আমি নিজেও আমার অসুস্থতার জন্য মানত করে সুস্থ হয়েছি। ওই সময়ে এখানে মোরগ-পোলাও করে সবাইকে খাইয়েছিলাম।

রাজশাহীর রহনপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রাম থেকে আসা রোকসানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলের সুস্থতা কামনায় হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া নিতে এসেছি। শুনেছি এখানে মানত করলে এবং পানি পড়া নিয়ে খাওয়ালে ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে উঠা সম্ভব। অনেকেই সুস্থ হয়েছে জেনেই এসেছি। নামাজ পড়া শেষে হুজুর পানিতে দোয়া পড়ে দিলেন।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কামারগাঁও ইউনিয়নের কামারগাঁও গ্রাম থেকে আসা দর্শনার্থী নাজমুল ইসলাম বলেন, পাশ্ববর্তী জেলা হওয়ায় কুসুম্বা মসজিদে সুযোগ পেলেই আসা হয়। এখানে আসার পর নামাজ পড়লে অন্যরকম শান্তি লাগে। ঐতিহাসিক এই মসজিদকে ঘিরে অনেক গল্প লুকিয়ে আছে। স্থানীয়রা একেকজন একেকভাবে গল্প শোনান। তবে যতটুকু জেনেছি এই মসজিদ নির্মাণে ৫৬ বছর সময় লেগেছিল।

সৌরভ, আকাশ, রায়হানসহ কুসুম্বা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুসুম্বা শাহী মসজিদ আমাদের নওগাঁ জেলার গর্ব। পাঁচ টাকার কাগজের নোটেও মুদ্রিত রয়েছে এ মসজিদের ছবি। দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত পর্যটকরা এখানে আসেন। অথচ এখানে খুব বেশি উন্নয়ন কাজ হয় না। এই মসজিদকে ঘিরে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আন্তরিকতা প্রয়োজন।

কুসুম্বা শাহী মসজিদের মুয়াজ্জিন ইসরাফিল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার আমলে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে দীর্ঘ ৫৬ বছর পর গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ’র শাসনামলে এই মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হয়। বর্তমানে এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। মসজিদে মহিলাদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই দর্শনার্থীরা এই মসজিদ দেখতে আসেন।

তিনি আরও বলেন, সুলতানি আমলের ঐতিহাসিক এ নিদর্শন দেখতে দূরদূরান্ত থেকে যারা আসেন তাদের থাকার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের রেস্ট হাউজে স্বল্প খরচে পর্যটকরা থাকতে পারেন। অনেক উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। তবে মসজিদের ভেতরের বেশ কিছু জায়গায় নোনা এবং ফাটল ধরেছে। এসব সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঐতিহাসিক কুসুম্বা শাহী মসজিদের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে প্রত্নত্বত্ত বিভাগ। প্রত্নত্বত্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধি হিসেবে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান এটি দেখভাল করেন। সেখানকার কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুসুম্বা মসজিদ প্রত্নত্বত্ত অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বেশি হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি মসজিদের কিছু কিছু স্থানে নোনা আমাদের নজরে এসেছে। কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যেই বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার কারণে এবার সেগুলো সংস্কার করা যায়নি। আগামী অর্থবছরে নতুন বরাদ্দ এলে সেটি সংস্কার করা হবে। এক্ষেত্রে প্রাচীন আদল ঠিক রেখে সংস্কার করাসহ পর্যটক কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে কাজ চলমান রয়েছে।

এমজেইউ