সাত বছর ধরে এভাবেই শেকলে বাঁধা জীবন ‍নুর আলমের। ছবি : ঢাকা পোস্ট

নুর আলম বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়। এক দশক আগেও স্বাভাবিক জীবন ছিল তার। মহানন্দা নদীতে নুড়ি পাথর উত্তোলন করে চালাতেন পরিবার। তবে হঠাৎই তার সেই সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। পাথর উত্তোলন করার সময় সীমান্ত অতিক্রম করায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন। এরপর তিন বছর ভারতের কারাগারে ছিলেন। কারাভোগের পরই হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। পরিবারের একমাত্র সন্তান একসময় পুরো পরিবার চালাতেন আর এখন তার বৃদ্ধা মা নুর নেহার অন্যের বাড়িতে কাজ করে সন্তান ও নাতিদের খাদ্যের জোগান দেন।

নুর আলম পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সর্দারপাড়া গ্রামের মৃত হকিকুল ইসলাম ও নুর নেহার দম্পতির ছেলে। সংসারে তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে নুর আলমের। 

জানা যায়, ভারতের কারাগার থেকে মুক্তির পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন নুর আলম। মাঝে মাঝে পাগলামি বেড়ে গেলে প্রতিবেশীদের ওপর হামলা করতেন। স্বামীর এমন আচরণে বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় নুর আলমের স্ত্রী। পরে উপায় না দেখে ছেলেকে শেকলে আবদ্ধ করেন বৃদ্ধ বাবা-মা। এভাবেই কেটে যায় সাত বছর।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির একটি ঘরের মধ্যে সিমেন্টের একটি খুঁটিতে বাম হাত শেকলে বাঁধা নুর আলম। শুয়ে, বসে ও ঘরের মধ্যেই পায়চারি করে চলে দিন রাত। কম্বল গায়ে শুয়ে থাকেন বেশির ভাগ সময়। ঘরের মধ্যে খাবার দিয়ে আসেন বৃদ্ধা মা নুর নেহার। কাছে কাউকে যেতে দেখলেই পা জড়িয়ে শেকল খুলে দিতে আকুতি জানান। মুক্ত হতে চান এ শেকলে বাঁধা জীবন থেকে। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে কখন কার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে এমন আশঙ্কায় বুকে পাথর বেধেই ছেলেকে এভাবেই সাত বছর ধরে শেকলে বেঁধে রেখেছেন অসহায় বৃদ্ধ মা।

দিনের বেশিরভাগ সময় কম্বল গায়ে শুয়ে থাকেন নুরে আলম। ছবি : ঢাকা পোস্ট

কর্মক্ষম ছেলে পাগল হওয়ার পর থেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন মা নুর নেহার। তিন নাতনিকে নিয়ে দিনরাত পার করতে হচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। অর্থের অভাবে একমাত্র ছেলের চিকিৎসা করাতে না পারায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। এর মধ্যে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে নুর আলমের বড় মেয়েরও। টাকার অভাব ও বাবার অসুস্থতার কারণে বিয়ে দিতে পারছেন না।

বৃদ্ধা মা নুর নেহার বলেন, আমার একমাত্র ছেলে নুর আলম আগে সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল। পাশের মহানন্দা নদীতে পাথর তুলতে গিয়ে বিএসএফের কাছে ধরা পড়ে। পরে তাকে নিয়ে তিন বছরের বেশি সময় ভারতে কারাগারে বন্দি করে রাখে তারা। জেল খেটে বাড়িতে এসেই আবোল তাবোল কথা বলতে শুরু করে। ভেবেছিলাম ঘোরে আছে। কিন্তু আস্তে আস্তে সে পাগল হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা খরচ করলেও সুস্থ করতে পারিনি। সে একটু উদ্ভট ও বদমেজাজি টাইপের। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে বাইরের মানুষের ওপর, এমনকি আমাদেরকেও মারধর করে। মানুষজন বাড়িতে অভিযোগ নিয়ে আসে। উপায়ন্তর না দেখে সাত বছর ধরেই ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।

তিনি আরও বলেন, আমি এখন অসহায়। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেটা সংসারের হাল ধরল। কিন্তু বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে ভারতে জেল খেটে আসার পর পাগল হয়ে গেল। এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলে ও তার সন্তানদের নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি। আমার তেমন টাকা পয়সা নেই যে ছেলের উন্নত চিকিৎসা করাব। বাধ্য হয়েই বুকে পাথর বেধে ছেলেকে ঘরের খুঁটির সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি। সন্তানের এমন করুণ পরিণতি ও মানবেতর জীবনযাপন বৃদ্ধ বয়সে আর সইতে পারছি না। আমার সন্তানের চিকিৎসায় যদি কেউ এগিয়ে আসতেন। তাই সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সবার কাছে সহযোগিতা কামনা করছি।

সারাদিন বসে আর শুয়ে থেকেই জীবন কাটে নুর আলমের। ছবি : ঢাকা পোস্ট

স্থানীয় নারী জোসনা ও নার্গিস বেগম বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মাহত। সাত বছর ধরে নুর আলমকে শেকলে বেঁধে রেখেছেন। তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। নুর আলমের চার ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। বাকি আর তিন সন্তান রয়েছে। তার পাগলামির কারণে স্ত্রীও তার বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। সংসারই চলছে না, চিকিৎসা করাবে কীভাবে। সমাজের দানশীল বিত্তবানরা যদি তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন তাহলে ভালো হতো।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক ফেরদৌস আলম লিটন বলেন, নুর আলম আমার পাশের গ্রামের বাসিন্দা। আগে অনেক ভালো ছিল। ভারত থেকে কারাভোগ শেষে বাড়িতে এসে কিছুদিনের মধ্যে পাগল হয়ে যায়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে তার পরিবার সাত বছর ধরে শিকল বন্দি করে রেখেছেন। তার মা ও সন্তানরা ও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছেলেটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে হয়ত ভালো হতে পারে। 

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি অবগত রয়েছি। মানসিক ভারসাম্যহীন নুর আলম দীর্ঘ দিন ধরে শিকলে বাঁধা বন্দী জীবনযাপন করছেন। তাকে পারিবারিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হলেও সেই সে চিকিৎসার যথাযোগ্য হয়নি। তার বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করব উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করার।

এএএ