‘আগে ধান কাটতে অনেক শ্রমিক লাগত, অনেক সময় লাগত। কিন্তু এখন শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক সুবিধা হইসে এই মেশিন দিয়ে ধান কাটি।‘ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বোরো ধান কাটার উপকারিতার কথা এভাবেই ব্যক্ত করলেন নোয়াখালীর সদরের ধর্মপুর ইউনিয়নের স্বাবলম্বী কৃষক মোহাম্মদ সোহেল।

শুধু সোহেলই নন, নোয়াখালী জেলার প্রতিটি উপজেলার কৃষকই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। তবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি― একসঙ্গে তিন কাজ করা সম্ভব হচ্ছে।

যদিও এসব মেশিনের দাম সাধারণ কৃষকদের নাগালের বাইরে। কম্বাইন হারভেস্টারের দাম ২৯ থেকে ৩২ লাখ টাকা। কয়েক বছর ধরে সরকারি প্রণোদনায় দেওয়া কম্বাইন হারভেস্টার গিয়ে কম সময়ে বেশি ধান কাটছেন কৃষকরা।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কৃষিকাজের জন্য নোয়াখালীর কৃষকদের মালিকানায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মাড়াইকল ও কয়েক হাজার পাওয়ার টিলার রয়েছে। কৃষি ও কৃষকদের সুবিধার্থে ৫০ থেকে ৭০ ভাগ সরকারি প্রণোদনায় দেওয়া ১৩৩টি রিপার ও ৫৯টি কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকরা বিভিন্ন জেলা থেকে ৫০টি কম্বাইন হারভেস্টার ভাড়া এনেছেন। এতে শ্রমিক-সংকট লাঘব হচ্ছে। কম সময়ে বেশি জমির ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করা হচ্ছে।

নোয়াখালীর সদর উপজেলার কৃষক মোহাম্মদ জামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার প্রকল্প ৯ একরের। প্রতি বছর ৯ একরের ধান কাটতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়। এ ৯ একর ধান কাটতে আমার ১৫ থেকে ১৬ দিন সময় লাগে। কিন্তু বর্তমানে এই মেশিনটার কারণে এক দিনেই ধান কাটা শেষ। শুকাতে লাগবে আর দুই দিন। 

তিনি বলেন, লেবারেরও অশান্তি, বৃষ্টিবাদল। ভবিষ্যতে এই মেশিনটা থাকলে কৃষকরা অনেক লাভবান হবেন এবং কৃষকরা আরও আগ্রহী হবেন ধান উৎপাদন করতে।

তরুণ উদ্যোক্তা কম্বাইন হারভেস্টারের চালক আবদুল হক বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রণোদনায় যে কম্বাইন হারভেস্টারটি দেওয়া হয়েছিল, তা আমি গত বছর ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে পেয়েছি। গত বছর ও এই বছর আমি অনেক ধান হারভেস্ট করেছি। কৃষক পর্যায়ে এই মেশিনটির যথেষ্ট চাহিদা আছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে খুব দ্রুত ফসল ঘরে তোলার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, এ মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা ছাড়াও মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দি― সব একসঙ্গে করা সম্ভব। প্রতিদিন এই মেশিন দিয়ে আট একর জমির ধান কাটা যায়। এক একর ধান কাটতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। পাশাপাশি এক ঘণ্টায় ডিজেল খরচ হয় ৮ থেকে ১০ লিটার। এই মেশিন পেয়ে কৃষকরা যেমন আনন্দিত, তেমনি নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা খুব আনন্দিত।

জেলা কৃষি প্রকৌশলী শারমিনা নাসরিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালী জেলায় মোট ৩৭ লাখ ২৭ হাজার ৬৭২ জন জনসংখ্যার মধ্যে কৃষক পরিবার আছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৯১ জন। জেলার উপকূলবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলায় ৭০ শতাংশ প্রণোদনায় কৃষকদের রিপার ও হারভেস্টার দেওয়া হচ্ছে। বাকি উপজেলাগুলোতে ৫০ শতাংশ প্রণোদনায় দেওয়া হচ্ছে। জনসংখ্যা হিসাবে এসব যন্ত্রপাতি পর্যাপ্ত নয়, প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যে কারণে বাইরে থেকে মেশিন ও শ্রমিক আনতে হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাষাবাদে যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষকদের ব্যাপক আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে বোরো জমি চাষে কৃষকরা সবকিছু করছেন যন্ত্রপাতিতে। নোয়াখালী জেলায় এখন পর্যাপ্ত পাওয়ার টিলার ও মাড়াইকল রয়েছে। তবে কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকদের চাহিদার তুলনায় কম।

পুরো জেলায় শতভাগ ধান মেশিন দিয়ে কাটতে হলে অন্তত দুই হাজার কম্বাইন হারভেস্টার প্রয়োজন মনে করে তিনি বলেন, এসব মেশিনের দাম বেশি, কারণ এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া সব জমিতে হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা সম্ভব নয়। তবে সরকার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রণোদনায় এসব মেশিন কৃষকদের দিচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোয়াখালীতে প্রায় চার লাখ কৃষিশ্রমিক রয়েছেন। তারা উপকূলীয় এলাকাসহ পুরো জেলায় ধান কাটা-মাড়াই করেন। আধুনিক কৃষিব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। মেশিনের সহযোগিতায় স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে তাদের ধান ঘরে তুলতে পারবেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে জেলায় কৃষি ও কৃষকদের সুবিধার্থে ৫০ থেকে ৭০ ভাগ সরকারি প্রণোদনায় দেওয়া ১৩৩টি রিপার ও ৫৯টি কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে। এতে কৃষকদের সময় ও খরচ দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।

এনএ