বাসাবাড়ি থেকে ৭১ লাখ টাকা মূল্যের নকল ওষুধ জব্দ

বিভাগের অন্তত পাঁচ জেলার রোগীদের উন্নত চিকিৎসায় ভরসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকেও এখানে চিকিৎসা নিতে লোকজন আসেন। নগরীতে দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ কিছু ক্লিনিক এবং রোগ নির্ণয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নেই নিজস্ব ড্রাগ সেন্টার। আর সেই কারণেই নগরজুড়ে ওষুধের কারবারও জমজমাট। কেবল রামেক হাসপাতাল এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ফার্মেসি।

অভিযোগ রয়েছে, এসব ফার্মেসিতে দীর্ঘ দিন ধরেই নকল, ভেজাল ও নিম্মমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ওধুষ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালালেও বন্ধ হয় না এই কারবার। উল্টো ব্যবসায়ীরা লোকজনকে জিম্মি করে আন্দোলনে নামেন।

গত শুক্রবার রাতে নগরীর চন্দ্রিমা থানাধীন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উত্তর পাশের একটি বাসা থেকে ৭১ লাখ টাকা মূল্যের নকল ওষুধ জব্দ করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় একই কাণ্ডের হোতা শরিফুল ইসলাম ওরফে আনিস ও তার ভাই রবিউল ইসলামকে। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে চন্দ্রিমা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে।

শরিফুল ইসলাম আনিস ও রবিউল ইসলাম

গ্রেফতারের পর আনিস পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, অন্তত দুই বছর ধরে তিনি এই বাসা থেকে নকল ওষুধ তৈরি করে আসছিলেন। এখান থেকে উৎপাদিত নকল ওষুধ নামিদামি কোম্পানির মোড়কে চলে যেত নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে। কতিপয় অসাধু ডিলারের হাত ঘুরে নকল ওষুধ ছড়িয়েছে আশেপাশের জেলাগুলোতেও।

এদিকে, বাসাবাড়িতে এতদিন তৈরি হচ্ছিল রিলায়ান্স ফার্মাসিউটিক্যালসের অ্যান্টিবায়োটিক ইলিক্সিম-২০০ ক্যাপসুল। দুই বছর ধরে জীবন রক্ষাকারী এই ওষুধটির নকল না জেনেই নিচ্ছিলেন রোগীরা। কেবল ইলিক্সিম নয়, একই বাসায় তৈরি হচ্ছিল রিলায়েন্সের রিলামক্স-৫০০, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেকলো-২০ মিলিগ্রাম, নাভানার পিজোফেন এবং এসবি ল্যাবরেটরিজের যৌন উত্তেজক পাওয়ার-৩০।

২২ লাখ টাকার একটি বিলিস্টার মেশিন ও প্রায় আড়াই লাখ টাকার কমপ্রেসার মেশিনে নকল ওষুধ তৈরি হচ্ছিল এতদিন। অভিযানে এসব মেশিনও জব্দ করে পুলিশ।

চিকিৎসকদের মতে, ইলিক্সিম-২০০ মূলত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, গলবিলপ্রদাহমূলক ব্যাধিবিশেষ এবং টনসিল, মূত্রনালীর সংক্রমণ, প্রদেহ, ক্রনিক ব্রংকাইটিস তীব্রতা, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ও নিউমোনিয়া চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। আর রিলামক্স ৫০০ ব্যবহার হয় নাক-কান-গলার সংক্রমণ, যৌন ও মূত্রনালীর সংক্রমণ, ত্বক ও ত্বকের কাঠামাের সংক্রমণ প্রতিরোধে।

স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সেকলো ১২০ পিসের একটি প্যাকেটের বাজার মূল্য ৭২০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতিটি ক্যাপসুলের খুচরা বাজারমূল্য ৬ টাকা। এই ওষুধটি নকল করে বাজারে দিলে উৎপাদন খরচ প্রতি পিস ১ টাকা করেও হবে না। কাজেই পুরো মুনাফাই তখন যাবে এই অসাধু সিন্ডিকেটের পকেটে।

স্কয়ারের স্থানীয় একজন বিপণন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, সেকলো ২০ ওষুধটি চিকিৎসকরা সর্বাধিক প্রেসক্রিপশনে দিয়ে থাকেন। ওষুধটির নিরাপত্তা নিয়ে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সারাবছরই সক্রিয় থাকে। এমনকি এর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলসহ প্যাকেজিংয়ের অনেক কাজই দেশের বাইরে থেকে করে নিয়ে আসা হয়।

যেকোনো নকল ওষুধ বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান খান। তিনি বলেন, যদি তাতে (ওষুধ) মূল উপাদান না থাকে, তাহলে কোনো কাজই করবে না।

তিনি আরও বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে আরও বড় বিপদ হলো, যদি এতে অপ্রতুল মূল উপাদান থাকে, তাহলে ওই ব্যাকটেরিয়া সেই অ্যান্টিবায়োটিকটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। এটাকে বলা হয়ে থাকে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স।

বিলিস্টার ও কমপ্রেসার মেশিনে তৈরি করা হতো নকল ওষুধ

এদিকে, নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীকে পাকড়াও করার পর সিন্ডিকেটের সন্ধানে নেমেছে নগর পুলিশ। আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, এর পেছনে আর কারা আছে, কোথায় এসব বিক্রি হতো, সব আমরা খুঁজে বের করব। এখনও বাজারে তাদের এসব নকল ওষুধ রয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছে, গত দুবছর ধরে তারা এই কারবার চালিয়ে আসছে। খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই যাতে নকল ওষুধ বুঝতে না পারেন, সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট কিছু অসাধু ডিলারের মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত করছিল। জড়িত ডিলারদের খুঁজছে পুলিশ। তাছাড়া নকল ওষুধের মোড়ক প্রস্তুতকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

গ্রেফতার আনিস সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, নকল ওষুধের এই কারবার চালাতে থানার ওসি, পুলিশ ফাঁড়ি, সিটিএসবি এমনকি সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচয়দানকারী চারজনকেও লাখ টাকা মাসোহারা দিতে হতো।

জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জেলার সহকারী বলেন, সব ফার্মেসিতে নকল ওষুধ বিক্রি হয়, তা ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই। কিন্তু কিছু কিছু ব্যবসায়ী মুনাফার লোভে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করেন। জেনে বুঝেই তারা এই কাজটি চালিয়ে যান।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএসআর