ডালডা অথবা ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে আটা মাখিয়ে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাদ্য লাচ্ছা সেমাই ছাড়া ঈদ যেন কল্পনাই করা যায় না। এর উৎপত্তি বগুড়ায় না হলেও প্রায় ৫ দশক ধরে এই জেলায় তৈরি লাচ্ছা সেমাইয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়েছে সারাদেশে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে দক্ষ কারিগরের সহজলভ্যতা এই সুনামকে আরও বিস্তৃত করেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি বছর শুধু ঈদ মৌসুমকে ঘিরে বগুড়ায় কয়েকশ কোটি টাকার লাচ্ছা সেমাইয়ের ব্যবসা হয়ে থাকে। এবারও রমজানের শুরু থেকে লাচ্ছা সেমাই তৈরির কর্মযজ্ঞে নেমেছেন ব্যবসায়ী ও কারিগররা।

বগুড়ায় অধিকাংশ বেকারি ব্যবসায়ী সেমাই প্রস্তুত ও সরবরাহ করে থাকেন। বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদ নামে সংগঠনের তথ্যমতে, জেলায় প্রতি বছর ঈদের বাজারে অন্তত ১৫০টি কারখানায় প্রায় ১৬ হাজার টন লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব সেমাই উত্তরাঞ্চল এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের সব জেলায় যায়।  জেলায় ব্র্যান্ড (মোড়কজাত) কারখানা ৮ থেকে ১০টি। বাকিগুলো নন ব্র্যান্ড (খোলা বা বাঁশের খাচিতে)। এসব নন ব্র্যান্ড কারখানার অধিকাংশই মৌসুমী ব্যবসায়ী।

এই সময়টায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনেক মৌসুমী কারিগররা যুক্ত হন। তারা জানান, লাচ্ছা সেমাইয়ের মূল উৎপত্তি পাকিস্তানে। মূলত দেশ স্বাধীনের আগে বিহারীদের হাত ধরে এদেশে লাচ্ছার প্রচলন শুরু হয়। বগুড়ার অধিকাংশ কারিগররা তাদের কাছে থেকেই লাচ্ছা তৈরি শিখেছেন। পঞ্চাশের দশকে সৈয়দপুরে প্রচুর লাচ্ছা তৈরি হতো। সেখানকার কারিগরদের কাছ থেকে শিখে বগুড়ায় চালু করা হয়। এরপর কালক্রমে বগুড়াই হয়ে উঠে উত্তরবঙ্গের লাচ্ছা সেমাই তৈরি ও বিক্রির ঘাঁটি।

খাজা বেকারির কারিগর শিবগঞ্জ উপজেলার টেংরা এলাকার মো. হাসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ২০০১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত রয়েছেন। নিজেও এক বিহারি লাচ্ছার কারিগরের কাছ থেকে এই কাজ শিখেছেন। 

হাসান বলেন, প্রায় ৫০-৫৫ বছর আগে পাকিস্তানের এক নারী এই লাচ্ছা সেমাই তৈরি করেন। তার মাধ্যমে বাংলাদেশের বগুড়ায় লাচ্ছা তৈরি শুরু হয়। আমিও সৈয়দপুরের আব্দুল লতিফ নামে এক বিহারির কাছে শিখেছি। উনি এখন বেঁচে নেই।

একই উপজেলার মোকামতলার আরেক কারিগর মোমিন সরকার। তিনি শুধু ঈদ মৌসুমে সেমাইয়ের কাজ করেন। অন্য সময় তার নিজের বেকারির ব্যবসা দেখেন। মোমিন জানান, এই মৌসুমে আমরা প্রতিদিন ১৬-১৭ বস্তা আটা থেকে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করি। প্রতিদিন ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে কাজ শুরু হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।

কারিগররা জানান, প্রত্যেক কারখানায় ৮ থেকে ১২ জনের একটি করে দল থাকে। এদের দুজন খামির তৈরি করেন। তিন থেকে চারজন সেমাইয়ের চাকা তৈরি করেন। আরও দু থেকে তিনজন সেই চাকা নিয়ে তেলে ভাজেন।  বাকি কয়েক জন সেমাই খাচিতে তোলেন।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, তিন ধরনের লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হয়ে থাকে। ঘি, ডালডা ও সয়াবিন তেলে ভাজা সেমাই। এ ছাড়া এগুলো মোটাদাগে দুভাগে ভাগে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। ব্র্যান্ড আর নন ব্র্যান্ড।

নন ব্র্যান্ডের লাচ্ছা প্রতিকেজি ১২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্যাকেটজাত ব্র্যান্ডের সয়াবিনে ভাজা লাচ্ছা প্রতিকেজি ১৬০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। ডালডায় ভাজাগুলো ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, ঘিয়ে ভাজা ৮০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে।

বগুড়া শহরের কলোনী এলাকার খুচরা বাজারের ব্যবসায়ী মো. নয়ন ইসলাম বলেন, লাচ্চা সেমাই এবার খুবই মানসম্মত। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী লাচ্ছা সেমাই পেয়ে ক্রেতারা সন্তুষ্ট। ঘিয়ে ভাজা সেমাই ৭০০ টাকা কেজি। নন ব্র্যান্ড ১২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজি। আকবরিয়া ৩৪০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এশিয়ার সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকা কেজি। শ্যামলীর সেমাই ২৪০ টাকা কেজি। সাদা ১০০ টাকা, ভাজা লাচ্ছা সেমাই ১২০ টাকা কেজি।

বগুড়ার শ্যামলী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের বেকারি শাখার ব্যবস্থাপক কীর্ত্তণ কুমার দাস বলেন, ডালডা লাচ্ছা আছে ২৪০ টাকা আর প্রিমিয়াম লাচ্ছা ২৬০ টাকা। এটা আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তবে এবার ঈদ উপলক্ষ্যে বাজার তেমন একটা জমে ওঠেনি। গতবার দৈনিক আমাদের যেখানে ৮০-৯০ হাজার টাকার লাচ্চা সেমাই বিক্রি হতো। কিন্তু এবার ৩০-৪০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।

কাহালু উপজেলার জাকারিয়া বলেন, ঈদের কেনাকাটা করার জন্য কাহালু উপজেলার কাজীপাড়া থেকে বগুড়া শহরে এসেছেন জাকিরুল ইসলাম। সাত মাথার নিউ মার্কেট এলাকায় কথা হলে তিনি জানান, আমাদের ঐতিহ্যের লাচ্ছা সেমাই কিনেছি তিন কেজি। ঈদ উপলক্ষ্যে এটা কিনতেই হবে। এরপর আমরা কিনি অল্প পরিমাণ। কিন্তু ঈদে কেনা লাগবেই।
 
বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বায়েজিদ শেখ জানান, বগুড়া লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে দেশসেরা। এখানে প্রচুর দক্ষ কারিগর রয়েছে। এ জন্য স্থানীয় ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে অনেক কোম্পানি সেমাই তৈরি করে নিয়ে যায়। লাচ্ছার চাহিদা কমে না, বরং প্রতি বছরই বাড়ে। গতবার জেলা থেকে ৪০০ থেকে ৪৩০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। এবার সেই ব্যবসার পরিমাণ অন্তত ৪৮০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।

বেকারি ব্যবসায়ী এই নেতার পরিসংখ্যান বলছে, বগুড়ায় ঈদকে ঘিরে দেড় মাস ধরে মৌসুমীসহ অন্তত ২৫০ ব্যবসায়ী লাচ্ছা উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রতি কারখানায় গড়ে ১০ জন করে কারিগর ধরলে জেলায় আড়াই হাজার মানুষ এ কাজে নিয়োজিত। 

বগুড়া জেলা বিসিক কার্যালয়ের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজ রহমান বলেন, বগুড়ার এই সেমাইয়ের বাংলাদেশের মধ্যে বৃহৎ বাজার রয়েছে। আমাদের বিসিকেও সেমাইয়ের কয়েকটি কারখানা আছে। এখানকার সেমাই উত্তরবঙ্গ ছাড়াও ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় যায়। সেমাই শিল্পে উদ্যোক্তা যেভাবে তৈরি হচ্ছে এবং এখানে যেমন দক্ষ কারিগর আছে তাতে একটা সময় এটা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি হবে।
 
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/আরএআর