ঘরে দারিদ্রতা থাকলেও স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে সুখের জীবন ছিল চিনি বিবির। দূরারোগ্য রোগে জন্মের কিছুদিন পরই মারা যায় দুই সন্তান। ক্ষোভে স্বামী তালাক দেন চিনি বিবিকে। অভিমানে অন্য কোথাও ঘর বাঁধেননি তিনি। নিজের কিছু না থাকায় সৎ বোনের পরিত্যক্ত ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব চিনি বিবি। জীবনের এই শেষবেলায় এখন তার একমাত্র ভরসা সৃষ্টিকর্তা। দীর্ঘদিন ধরে ভাঙা পা নিয়েই অসুস্থ ও মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। 

শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীমুড়া নামা পাড়া এলাকার চিনি বিবির ভাগ্যে কখনো মেলেনি সরকারি সুবিধা। পরিবারের কোনো সদস্য না থাকায় ৬৬ বছর বয়সী গৃহহীন বৃদ্ধার একেকটি দিন কাটে যেন চরম দুর্দশায়। কখনো খেয়ে বা না খেয়ে কাটছে তার দিন। 

জানা যায়, স্থানীয় মৃত বয়জ উদ্দিনের মেয়ে চিনি বিবির ৩৫ বছর আগে বিয়ে হয় ঝিনাইগাতী উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামে। কোলজুড়ে দুই সন্তান এলেও দূরারোগ্য রোগে বাঁচেনি একজনও। সেই ক্ষোভে স্বামী তালাক দেন তাকে। পরবর্তী সময়ে ৩০ বছর ধরে নিজ গ্রাম লামাপাড়াতেই অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করে দিন কাটাচ্ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা এ নারী। হঠাৎ বছর দুয়েক আগে কাজ করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে একটি পা ভেঙে যায় তার। চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারায় ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়েন তিনি। 

আট বছর আগে চিনি বিবির সহোদর ভাই মিয়ার উদ্দিনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই তার খোঁজ নেয় না কোনো স্বজন। নিদারুণ কষ্টে থাকা এই বৃদ্ধার অবলম্বন বলতে কেউই নেই এখন। সৎ বোনের পরিত্যক্ত ঘরে বসতি গড়লেও তার মনে আছে আশ্রয় হারাবার ভয়। ভাঙা পা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন না তিনি। 

চিনি বিবি বলেন, ‘নিজের বলতে কিছুই নেই আমার। যা ছিল আল্লাহ সব নিয়ে গেছেন। বাপ-মা, ভাই-বোন সবাই মারা গেছে। পা ভাঙার পর এখন ভাঁজ হয় না। কোমরের ব্যথায় দাঁড়াইতে পারি না। ছেঁচুড় পাইরা চলা লাগে। খাবার না জুটলে না খাইয়াই থাহা লাগে। ডাক্তর দেহানির টেহাও নাই, মানুষও নাই।’ 

তিনি আরও বলেন, এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বর কেউ আমার খোঁজ নেয় না। যার কিছু নেই, তার খোঁজ নেওনের কেউ থাহে না। এত কষ্ট আর সইতে পারি না। এহন আল্লাহ আমারে নিয়া গেলেই ভালা। ঘর নাই, বিছনা নাই। পরের জাগায় থাহি, কবে তুইল্লা দেয় আল্লাই জানে।

স্থানীয় বাসিন্দা খলিল মিয়া বলেন, পা ভাঙার পর থেকে চিনি বিবির ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। সৎবোনের একটি ভাঙা ঘরে থাকলেও মাঝেমধ্যে বকাঝকা করে তারা। এক সময় মানুষের বাড়িতে কাজ কর্ম করলেও এখন সে নিজেই চলতে পারে না। তার কোনো আত্মীয়-স্বজন খোঁজ খবর নেয় না। তবে চিনি বিবি কারো কাছে হাত পাতে না, কেউ ইচ্ছে করে দিলে খাওয়া জোটে না হলে উপোষ থাকে। এই রোজার মাসেও তিনি না খেয়ে রোজা রাখছে। গ্রামের ধনী মানুষেরা আরেক ধনী মানুষের খোঁজ নেয়, গরিবের নেয় না।

স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর আল আমিন হিরু বলেন, ৩০ বছর ধরে চিনি বিবি এ এলাকায় আছে। ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ভাই সবাই মারা গেছেন। অসুস্থ চিনি বিবির খাবার জোটে না। মাঝেমধ্যে কেউ খাবার দিলে তা খেতে পারে। চিনি বিবির পায়ের চিকিৎসা ও একটি হুইল চেয়ার জরুরি প্রয়োজন। 

মানবাধিকার সংস্থা সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির সহকারী পরিচালক নাঈম ইসলাম বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন রিকশাওয়ালাদের কাছে তার জন্য ওষুধ পাঠিয়ে দেই। এ রমজানে তার কাছে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে, তার কষ্ট দেখে কেউ চোখে পানি আটকাতে পারবে না। দীর্ঘদিন ধরে পা ভাঙা থাকায় আর হাঁটতে পারে না। তাই সে বসে বসে ঘর থেকে বের হয়। তার সৎবোনের পরিত্যক্ত ঘরে থাকছে, কিন্তু তারাও কয়েকবার সেখান থেকে বের করে দিয়েছিল। স্থানীয় কয়েকজন বুঝিয়ে আবার সেখানে তুলে দিয়েছে। তার বাবার রেখে যাওয়া সামান্য ভিটেরও কোনো হদিস নেই। ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, ভাই কেউ বেঁচে নেই, দুই ভাতিজাও (দিনমজুরের কাজ করে) দেখাশোনা করে না। আমাকে চিনি বিবি জানিয়েছে, সরকারি কোনোরকম সহায়তা জোটেনি তার। খেয়ে না খেয়ে থাকে তিনি। চরম দুর্দশাগ্রস্ত এ বৃদ্ধার পাশে সরকার বা সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা জরুরি।

শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজাবে রহমত বলেন, দ্রুত চিনি বিবির খোঁজ খবর নিয়ে তাকে সহায়তা করা হবে। 

আরকে