ঈদের ছুটিতে ট্রেন, বাস ও লঞ্চ সবখানেই থাকে ঘরমুখো মানুষের চাপ। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে কর্মজীবী মানুষগুলো যাত্রাপথে শত কষ্ট আর নানা ভোগান্তি মাথায় নিয়েই বাড়ি ফেরেন। ট্রেনে জীবনঝুঁকি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে ছুটছেন কর্মজীবী মানুষগুলো। সৌখিন আলোকচিত্রশিল্পী সাদিক খানের ক্যামেরায় ধারণ করা এমন একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহ হয়ে জারিয়া ঝাঞ্জাইলগামী বলাকা ট্রেনটির ছাদেও যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ট্রেনের ছাদের দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসে গ্রামের পানে ছুটতে দেখা যায় শত শত মানুষকে। এমনকি বাদ যায়নি ট্রেনের ইঞ্জিনও। সামনের অংশের স্বল্প জায়গাতেই দুই পা ঝুলিয়ে হাসিমাখা মুখে সবাই ছুটছেন গ্রামের পানে। ঈদ যাত্রার এমন দৃশ্যটি মন কেড়েছে নেটিজেনদের। ভাইরাল সেই ছবিটি আপলোড হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজেও। ভাইরাল এই ছবির আদ্যোপান্ত ও সৌখিন ফটোগ্রাফার সাদিক খানের নানা গল্প জানার চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট। 

ঢাকা পোস্ট : ট্রেনে ঈদ যাত্রার ছবিটি এভাবে ভাইরাল হয়ে যাবে ভেবেছিলেন কি? 

সাদিক খান : ছবিটা তোলার পরেই দেখে ভেবেছি জীবনের অন্যতম সেরা একটা ছবি মনে হয় তুললাম। আর এরকম একটা ছবি তোলার ইচ্ছা ছিল অনেক বছর আগে থেকেই। 

ঢাকা পোস্ট : ছবিটি তোলার আগে ভাবনাটা কি ছিল?  

সাদিক খান : ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ কিংবা ‘নাড়ির টানে বাড়ির পানে’-শিরোনামের ছবি কয়েকদিন ধরেই তোলা হচ্ছে। ট্রাক ভর্তি ঠাসাঠাসি করে মানুষ বাড়ি ফিরছে। ট্রেনের ছাদে গাদাগাদি হয়ে গ্রামে ফিরছে মানুষ। ভাইরাল হওয়া ছবির আগের দিন বাকৃবি ক্যাম্পাসের ভেতরে সবুজের মাঝখান দিয়ে চলা ট্রেনে ঈদযাত্রার ছবি তুলেছিলাম। সেটাও বেশ প্রশংসিত। তবে সেটা ওপর থেকে তোলা ছবি ছিল না। তারপরই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, কেওয়াটখালি রেলব্রিজের ওপর থেকে ছবিটা তুলবো, তাহলে পুরো ট্রেনের ছাদের ছবি পাব। 

ঢাকা পোস্ট : ছবিটি তোলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই, কীভাবে, কোথা থেকে তোলা হয়েছে ছবিটি? 

সাদিক খান : আগের রাতেই ভেবেছিলাম সকালে জারিয়াগামী বলাকা কিংবা দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনের ছবি তুলব। এজন্য সেহরি খেয়ে আর ঘুমানোও হয়নি। সকাল সকাল ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালি রেলব্রিজ এলাকায় যাওয়া। শুরুতে রাস্তায় জ্যাম, ট্রাক, বাস ভর্তি মানুষের ছবি তুলেছি। পরে ট্রেনের সময় হলে রেলব্রিজের ওপর অবস্থান করি। ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত থাকি আর ভাবতে থাকি কখন আসবে কাঙ্খিত ট্রেন।


ঢাকা পোস্ট : ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর অনুভূতি কি, মানুষজন কি বলছে? 

সাদিক খান : ছবি ভাইরাল তো তখনই হয় যখন ছবিটা সবার দৃষ্টি কাড়ে। হৃদয় স্পর্শ করে। আর আমার ছবি প্রায়ই ছবিই ভাইরাল হয়। তখন অনেক ভালো লাগে। এর আগে কক্সবাজারে বৃদ্ধ দম্পতির হাতে হাত রেখে সমুদ্র দেখার ছবি, করোনাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলার একটা ছবি, শীতের কুয়াশাতে শম্ভুগঞ্জ রেলব্রিজের একটা ছবি, বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেক ছবি অনলাইন দুনিয়া সয়লাব হয়েছে। এবার ছিল ঈদের বাড়ি ফেরার ছবি। আমাদের নীড়ে ফেরার ছবি। একটা ছবি যখন সব মহলে প্রশংসা কুড়ায় ফটোগ্রাফারের প্রাপ্তির জায়গা তো এটাই। 

ঢাকা পোস্ট : কেন ছবিটি ভাইরাল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? 

সাদিক খান : ছবিটা পুরোটাই একটা আবেগ। এত্ত এত্ত ভিড়, এত্ত দুর্ভোগ নিয়ে আমরা শেকড়ের টানে বাড়ি ফিরছি প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। বাড়িতে পৌঁছালে বাবা-মা, সন্তান কিংবা পরিবারের প্রিয় মানুষদের মুখ দেখামাত্রই যাত্রাপথের এসব দুর্ভোগ হারিয়ে যায় ভোরের শিশিরের মতো। আর এজন্যই ছবিটা সবার মন ছুঁয়েছে। স্বপ্ন বাড়ি যাচ্ছে ।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্যও কাজ করছেন সাদিক। ফটোগ্রাফির আয় দিয়ে ঈদ শপিং করে তাদের ইচ্ছাপূরণ করেছেন তিনি।

 

ঢাকা পোস্ট : ফটোগ্রাফি কি শখ নাকি পেশা? 

সাদিক খান : ১০ বছর ধরে ছবির সঙ্গে আছি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই ফটোগ্রাফি করি। সবুজ ক্যাম্পাসের যত নান্দনিক সৌন্দর্য, ব্রহ্মপুত্র নদে একেক ঋতুতে একেক রূপ ফ্রেমবন্দি করতে থাকি। তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ময়মনসিংহের সৌন্দর্যকে। এভাবেই কেটে গেছে অনেক বছর। শখের কাজটাকে ক্যারিয়ার হিসেবেও বেছে নিয়েছি। এখন ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফার হিসেবে সারা দেশে ঘোরা হয়। বাংলাদেশে বই নিয়ে থিমেটিক বুক ফটোগ্রাফির আইডিয়া রয়েছে আমার। এখন শিল্পসাহিত্যের পাঠক কিংবা লেখক বুক ফটোগ্রাফার হিসেবে জানেন। কাপল ফটোগ্রাফিও করা হয় পছন্দের সব ফ্রেমে। ছবির জন্য কয়েকটা জেলা যাওয়া এখনো বাদ আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটা উপজেলায় ক্যামেরা হাতে ঘুরতে চাই। বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই বাংলার আনাচে কানাচে থাকা অবারিত সৌন্দর্যকে। এটা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এজন্য পৃষ্ঠপোষকতা দরকার । 

ঢাকা পোস্ট : ফটোগ্রাফি নিয়ে আপনার আর কি ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে? 

সাদিক খান : আমি গল্পের মানুষ। গল্প বলতে চাই। হোক তা আমার ছবিতে, হোক তা আমার লেখা কবিতায় কিংবা আমার গাওয়া গানে। আমি আমার নির্মাণে গল্প দেখাতে চাই দর্শককে। স্বপ্নবাজ মানুষ আমি। স্বপ্নকে আগলেই আজ এখানে আসা। আশা রাখি ইনশাআল্লাহ আমার সব স্বপ্ন একদিন প্রাণ পাবে। ডানা মেলে পাখির মতো আকাশে
উড়বে। এভাবেই সবার ভালোবাসা ও দোয়া চাই। আর স্বপ্নের এই কন্টকাকীর্ণ পথকে আমার জন্য একটু সহজ করতে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতাও চাই । 

ঢাকা পোস্ট : কোন স্বপ্নকে নিয়ে আপনি এগোচ্ছেন? 

সাদিক খান : অনেক বছর ধরেই আমি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করি। এবারের ঈদটা তাদের সঙ্গে কাটাবো বলে বাড়ি ফেরা হয়নি। আমার তোলা অন্যদের হাসিমুখের ছবির জন্য আজ আমি হাসি ফুটাচ্ছি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখে। কয়েকদিন ধরেই অনেক শিশুর ইচ্ছাপূরণের ঈদ শপিং করলাম শপিংমল ঘুরে ঘুরে। স্বপ্ন দেখি একদিন এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য একটা ফাউন্ডেশন গড়বো। আমার উপার্জনের বড় একটা অংশ আমি এসব মানুষদের জন্য খরচ করতে চাই। আমার তৃপ্তির জায়গা ভোগে নয় ত্যাগে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার জন্ম ও বেড়ে উঠা ও ফটোগ্রাফিতে জড়ানো নিয়ে জানতে চাই। 

সাদিক খান : আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার রায়ের বাকাই গ্রামে। তাই সব সময়ই বলি আমি গ্রামের ছেলে। গায়ে আমার লেগে আছে সোঁদা মাটির গন্ধ। গ্রামের স্কুলে পড়ালেখার পাঠ শেষে ময়মনসিংহ শহরে এসে কলেজ জীবন শুরু করেছিলাম। কলেজের নামও ব্রহ্মপুত্র কলেজ। এরপর ব্রহ্মপুত্র নদের প্রেমে পড়েই থেকে গেলাম এই শহরেই। ভর্তি হয়েছিলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদে। বাকৃবিই আমার সব শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর। এখানের পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে এখন এই দুর্গম পথেই হেঁটে চলেছি। একটু গতানুগতিক ধারার বাইরে। সমাজের চোখে তাই আমি স্রোতের বিপরীতে হাঁটা দুরন্ত এক স্বপ্নবাজ ছেলে ।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্নগুলো পূরণ হোক, আপনার জন্য শুভ কামনা নিরন্তর। ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 

সাদিক খান : ঢাকা পোস্টকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। 

এমএএস