‘আমার দুইটা ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেটা আজ প্রায় একমাস ধরে জিম্মি। আমি তার বাবা। ভাবতে পারেন? এখনো যে কথা বলছি, খাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি এটাই আল্লাহর কাছে অনেক শোকর। ছেলে এভাবে আছে আর এখানে আমাদের ঈদের আনন্দ কীভাবে থাকতে পারে? আমার ঈদ তো হবে ওইদিন যেদিন আমার ছেলে আমার বুকে আসবে, বলবে- আব্বু আমি তারেক, আমি সুস্থতার সাথে ফিরে এসেছি। আমার ঈদ হবে ওইদিন। মাংস পোলাও মিষ্টি সেমাই ওইদিনই আমরা খাব।’

সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা তারেকুলের বাবা মো. দেলোয়ার হোসেন (৬৪) এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তাদের এবারের ঈদ আয়োজন নিয়ে।

গতকাল বুধবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার বাড়িতে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ছকরিকান্দি গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ও  হাসিনা বেগমের (৬২) ছেলে তারেকুল। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তারেকুল। তার বড় বোন দুলিয়া সুলতানার (৪১) বিয়ে হয়েছে পাশের বোয়ালমারী উপজেলার একটি গ্রামে। বড় ভাই মো.হাসান ইসলাম (৩৬) ঢাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।

তারেকুল বিয়ে করেছেন ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকায়। তার স্ত্রীর নাম নুসরাত জাহান (২১)। তাদের এক বছর বয়সী তানজিহা ইসলাম নামে এক মেয়ে আছে। তারেকুল জিম্মি হওয়ার পর স্ত্রী নুসরাত মেয়েকে নিয়ে নাটোরের গুরুদাসপুর বাবার বাড়িতে আছেন।

এখন বাড়িতে থাকেন তারেকুলের বাবা ও মা এবং দাদী কুলসুম বেগম (৮৫)। ঈদ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) রাতে বাড়িতে এসেছেন বড় ভাই মো. হাসান ইসলাম।

তারেকুলের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মাঝকান্দি মোড় পার হয়ে আনুমানিক এক কিলোমিটার দূরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে। বাড়িটি এক তলা বিশিষ্ট একটি ভবন। ভবনটির চারপাশ সবুজ রঙের টিন দিয়ে ঘেরা।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, মাঝে মাঝে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য জলদস্যুরাই ব্যবস্থা করে দেয়। পরিবারের সবার খোঁজখবর নেওয়া ও নিজের সুস্থতার কথা জানানোর জন্য। তবে সেটা দেড় থেকে দুই মিনিটের ভয়েস কল। এর বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। এই কম সময়ে যতটুকু বলা যায় ততটুকুই বলে। ও শুধু আমাদের সাহস দেয়। বার বার বলে, ‘আব্বু চিন্তা কইরেন না। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেন সুস্থ মতো ফিরে আসতে পারি। আমি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ, চিন্তা কইরেন না।’

তারেকুলের বড় ভাই মো. হাসান বলেন, বয়সের বড় গ্যাপ না থাকার কারণে ও ছিল আমার বন্ধুর মতো। ছোটবেলা একসঙ্গে ঘুমাইছি, খাইছি, খেলাধুলা করছি। ওইগুলো মনে উঠলে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। ছোট ভাই তো মনে আর মানে না। যদি সুযোগ থাকতো আমরা যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে চাইতাম।

তিনি বলেন, আমি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। ও জাহাজে থাকতো বলে অনেক সময় আমাদের ছুটি মিলতো না। তবে নিয়মিত কথা হতো। ওদের জাহাজের বিভিন্ন বিষয়াদি দেখাত ভিডিও কলে। ও জাহাজে চাকরি নেওয়ার পর কয়েকটা ঈদ জাহাজে এবং বিদেশে করেছে। ওর ওখানে আগের দিন ঈদ হতো। তখন ঈদের দিন ছবি দিতো বা আমরা আমাদের ছবি পাঠাতাম। মনে আনন্দ থাকত, ঈদ ঈদ মনে হতো।

হাসান আরও বলেন, আমি, তারেকুল এবং চাচাতো ভাইসহ আমরা মোট চার-পাঁচজন সুযোগ পেলেই একসঙ্গে ঈদের আনন্দ করতাম। আমরা সবাই ব্যস্ত হলেও চেষ্টা করতাম ঈদে একসঙ্গে হওয়ার। আমরা এই চার-পাঁচ চাচাতো ভাই এক রঙের পাঞ্জাবি পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এক চাচা থেকে আরেক চাচার বাড়ি সেমাই-পোলাও খেতে যেতাম, সালামি নিতাম, ছোটদের দিতাম। এবার সেই পাঞ্জাবি বানানো হয়নি। তাহলে বোঝেন ভাইকে ছাড়া আমাদের ঈদ কেমন যাবে? আমাদের প্রস্তুতি কেমন?

তারেকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, আমরা দেখছি সরকার ও মালিকপক্ষ এদেরকে উদ্ধার করতে যথেষ্ট আন্তরিক। মালিকপক্ষ নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। খোঁজখবর নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তারা বলছে যেভাবেই হোক আমরা ওদের উদ্ধার করবো, শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা, একটু সময় লাগবে।

তিনি বলেন, আমি সব সময় জায়নামাজে পরে থাকি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার সন্তানসহ জিম্মি সকল সন্তানকে তার বাবা-মায়ের কোলে যেন আল্লাহ ফিরিয়ে দেন। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই ছেলের মুক্তির জন্য।

তারেকুলের দাদি কুলসুম বেগম বলেন, আমার দুইটা নাতিই সোনার টুকরা। তারেকুল প্রত্যেকবার বাড়ি আসার আগে ফোনে জিজ্ঞেস করত,দাদি তোমার কি খাইতে মন চায়? আমি বলতাম, আমার কিছুই খাইতে মন চায় না, তুই বাড়ি আয় তোরে দেখলেই আমার মন ভইরা যায়। তুই বাড়িতে আসলেই আমি খুশি। তাও আমার নাতি আমার জন্য আপেল মাল্টা আঙ্গুর আনতো। আর ঈদে আসলে তো আমার কাপড় কিনতো সবার আগে।

বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ কুলসুম বেগম। কথা বলার মাঝে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলেন। এরপর তারেকুলকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, কতদিন নাতিডারে দেখি না, আমার তারেকরে তুমরা আইনা দেও দি।

বাড়ির পাশের ছকরিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুর-১২ এলাকায় ডক্টর শহীদুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তারেকুল । একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৯ ও ২০১১ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে। পড়াশোনা শেষ করে ২০১৭ সালে চাকরি নেন চায়না কোম্পানির একটি জাহাজে। এরপর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে গত বছরের ১ ডিসেম্বর চাকরি নেন এস আর শিপিং লিমিটেডের ওই জাহাজে।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এটি মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। এতে ২৩ বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন। জলদস্যুরা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজ পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড।

আরএআর