ঈদ আনন্দ নেই বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বগা ও চারাখালি গ্রামের স্বজনহারা জেলে পরিবার গুলোতে। জেলা শহরের পূর্বদিক থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রাম দুটি। গ্রামগুলোর বেশিরভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে সাগরে মাছ ধরে। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তাদের। প্রতিবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বিদায় নেন অশ্রুভেজা চোখে। আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে স্বজনদের সাথে। তাদের এই আশঙ্কা অবশ্য ভুলও নয়।

সাগরে স্রোতে ট্রলারডুবিতে গত এক দশকে এই গ্রামেরই মারা গেছেন অর্ধশত জেলে। এর মধ্যে অনেক পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছে। হারানো স্বজনদের স্মৃতিই এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তাদের। এই অবস্থায় সরকারি ও বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন হতদরিদ্র এই জেলে পরিবারগুলো।

বুধবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে বগা জেলেপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, একটি টিনশেড ঘরের বারান্দায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে গভীর মনযোগে বাবার ছবি দেখছে দশ বছর বয়সী হামিম। ঈদে অন্য শিশুরা বাবার সান্নিধ্য পেলেও সে সুযোগ নেই হামিমের। মাত্র বয়স যখন ৯ মাস তখন তার বাবা অলিয়ার হলদার সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেননি। এরপর থেকেই বাবার ছবিই ভরসা হামিমের। শুধু হামিম নয়, কচুয়া উপজেলার বগা ও চারাখালি গ্রামের জেলেপল্লিতে অন্তত ৩০টি পরিবারের অবস্থা একইরকম।

সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেননি এসব পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম জেলেরা। জীর্ণশীর্ণ ঘরে বসবাস আর, অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে সাগরে প্রাণ হারানো জেলে পরিবারের। প্রচন্ড আর্থিক সংকটে ঈদ আনন্দ মেলে না এসব পরিবারে। এমনকী এই পরিবারগুলো সরকারি সহযোগিতাও পায়নি। উৎসবের কোনো রংই ছুঁতে পারে না এসব পরিবারের সদস্যদের।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জীবিকার তাগিদে পরিবারের সবাইকে রেখে এই গ্রামের জেলে মহিদুল মোল্লা (৩৫) ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যান। ৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে মহিদুলসহ সব জেলের জীবনে নেমে আসে কালরাত। ২১টি ট্রলার ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনসংলগ্ন দুবলার চরে এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অনেক জেলে সাঁতরে নিরাপদে তীরে আসতে পারলেও মারা যান ৭ জন। এর মধ্যে একজন মহিদুল।

মহিদুল মোল্লার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চাল ও কাঠের বেড়া দেওয়া ঘরটিতে তার মা-স্ত্রী-সন্তান বসবাস করে। ঘরের বারান্দায় বসে আছেন মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম। পাশেই বসা মহিদুলের মা হাসিনা বেগম ও তার ছোট ছেলে।

মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম বলেন, তিনটা ছেলে রেখে স্বামী মারা গেছেন। বড় ছেলেরে ১৭ পারার হাফেজ বানিয়েছিলাম। মনে অনেক আশা ছিল। কিন্তু ওর বাপ (বাবা) মারা যাওয়ার পর ও নিজে কাজে গেছে। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এখন দিনে দুই বেলা খেয়েও দিন কাটে, না খেয়েও কাটে। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচও দিতে পারি না। যেভাবে সব কিছুর দাম বেড়েছে সামনে কীভাবে চলবো তা জানি না। মাথায় কোনো কাজ করে না। সব উপরওয়ালার উপরে ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ বাঁচাইলে বাঁচবো না বাঁচাইলে আল্লাহ যেমন একজনরে নিছে সেইভাবে যেন আমাগোও নিয়া নেয়।

মহিদুল মোল্লার তিন ছেলের মধ্যে তরিকুল ইসলাম (১৫) সবার বড়। ১৭ পারা কোরআনের হাফেজ সে। দুই ছেলে আরিফুল (১৩) ও আবির (৯) স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবার মৃত্যুর পর তরিকুল পড়ালেখা ছেড়ে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। 

হাসিনা বেগম বলেন, ঐ সর্বনাশা বঙ্গোপসাগর আমার একমাত্র আদরের সন্তানকে কেড়ে নিছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে, মা টাহা (টাকা) পয়সা তেমন কিছু থুইয়ে (রেখে) যাইতে পারলাম না। যা আছে তাই অল্প অল্প করে খাইয়ো। আর আল্লাহ আল্লাহ কইরো। আমি কয়েকদিনের মধ্যে আসতেছি। তহন আল্লাহ দিলে ভালো-মন্দ খাইয়ো। ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসালেন এই মা। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেন, তারপর থেকে সব অন্ধকার। আমি ছেলের মুখখানও শেষবারের মতো দেখতে পারলাম না।

এমন চিত্র যে মহিদুলের স্ত্রী মুর্শিদা বেগমের তা নয়। একই গ্রামের বাসিন্দা হামিদা বেগম। তার স্বামীর নাম লেকওয়াত মোল্লা। তার স্বামীও মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছেন ২০১৬ সালে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,  ঘরের বারান্দায় বসে মাছ ধরার জাল ঠিক করছেন বৃদ্ধা। তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ঘোর অমানিশা নেমে আসে আমাগো জীবনে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছোট দুই ছেলে নিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে বাঁইছে আছি। শত কষ্টেও ছেলেদের লেখাপড়া করাচ্ছি। ওগো নাইগে (ওদের জন্য) একটু দোয়া করেন। 

এমন চিত্র শুধু মহিদুল মোল্লা ও লেকওয়াত মোল্লার পরিবারের না। একই চিত্র সাগর থেকে ফিরে না আসা সব জেলেদের পরিবারে।

কথা হয় স্বামী হারানো মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। তার স্বামীর নাম মো. তালেব। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের পরিবার তার। তিনি বলেন, সাগর থেকে স্বামী ফেরেননি আট বছর হলো। টেনেটুনে চলছে সংসার। কোনোদিন চুলায় আগুন জ্বলে আবার কোনোদিন জ্বলে না। কীভাবে যে দিন কাটে, তা শুধু আমরাই জানি।

জেলে ও মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ২০১৫ সালে ১৯ জন এবং ২০২২ সালে ৮ জনসহ গেল ১০ বছরে বগা ও চারাখালি গ্রামের অন্তত ৩০ জন জেলে প্রাণ হারিয়েছেন।

কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা আক্তার বলেন, বগা ও চারাখালি এলাকার জেলেরা খুবই আর্থিক কষ্টে থাকে। এখানে সব জেলে সরকারি চালও পায়না। এছাড়া ২০১৫ সালে মারা যাওয়া ১৯জনের পরিবার এখনও সরকারি সহযোগিতা পায়নি। জেলেদের কার্ড বৃদ্ধি ও নিহত জেলেদের সরকারি সহযোগিতার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হয়েছে বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।

শেখ আবু তালেব/পিএইচ