ময়মনসিংহ জেলায় দুই দিনে চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে জেলার নান্দাইল, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ নগরীতে পৃথক চার খুনের ঘটনা ঘটে। নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দিনদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, নান্দাইল পৌর সদরের চারিআনি পাড়া এলাকায় বুধবার (১৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টার দিকে নাজমা আক্তার (৩৫) নামের এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নাজমা আক্তার ওই এলাকার আব্দুল মান্নানের স্ত্রী। তিনি চার সন্তানের মা। নিহতের পরিবার ও পুলিশ জানায়, বুধবার রাতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন নাজমা। খাবার শেষে রাত ১০টার দিকে পান কিনতে বের হন তিনি। তবে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় পরিবারের লোকজন তার খোঁজ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ধানখেতে কোনো এক নারীর ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পড়ে রয়েছে বলে খবর দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খবর পেয়ে নাজমার পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে তাকে শনাক্ত করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।

এদিকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে তুচ্ছ ঘটনায় কিল-ঘুষিতে মোফাজ্জল হোসেন (১২) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিকেলে উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের বাঘবেড় গ্রামে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত মোফাজ্জল হোসেন ওই গ্রামের মৃত আলাল উদ্দিনের ছেলে। সে স্থানীয় পাইবাকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। পুলিশ জানায়, বাড়ির পাশে বসে খেলাধুলা করছিল একদল শিশু ও কিশোর। এ সময় চেয়ারে বসা নিয়ে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় মোফাজ্জেল হোসেনের। এ ঘটনায় ওই কিশোর ক্ষিপ্ত হয়ে মোফাজ্জল হোসেনকে কিল-ঘুষি ও লাথি মারে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় মোফাজ্জল।

এ ছাড়া ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে শেওড়া গাছের ডাল-পাতা কাটাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আব্দুল গনি (৬২) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। বুধবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এর আগে মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সকালে উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের কুমুড়িয়ার চর গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আরও তিনজন আহত হয়েছেন।

পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী নূর নবীর সঙ্গে নিহত আব্দুল গনির বসতবাড়ির জমি সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ চলছিল। মঙ্গলবার সকালে আব্দুল গনির বাড়ির পাশের একটি শেওড়া গাছের ডাল কেটে পাতা নিতে আসে নূর নবী। এ সময় আব্দুল গনি ও তার ভাই মোসলেম উদ্দিন গাছের ডালপালা কাটতে নিষেধ করেন। এতে নূর নবী ক্ষিপ্ত হয়ে তার ভাই রতন, জহির উদ্দিন, হাসেম এবং তাদের ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে দেশীয় লাঠিসোঁটা নিয়ে আব্দুল গনি ও তার ভাই মোসলেম উদ্দিনের ওপর হামলা চালায়। এ সময় দুপক্ষের সংঘর্ষে আব্দুল গনি, বেলাল ও তার স্ত্রী মঞ্জিলা খাতুন, মোসলেম উদ্দিন এবং তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা গুরুতর আহত হন। পরিবারের লোকজন তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুল গনি মারা যান।

অপরদিকে, ময়মনসিংহ নগরীর কলেজ রোড এলাকায় তুচ্ছ ঘটনায় ছুরিকাঘাতে সামিউল হক সামি নামের এক কিশোর খুন হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে কলেজ রোড মীরবাড়ী রেললাইন এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত সামি নগরীর মীরবাড়ি এলাকার সাইফুল ইসলামের ছেলে। সে একটি কমিউনিটি সেন্টারের অনিয়মিত খাবার পরিবেশক (ওয়েটার) হিসেবে কাজ করত। এ ঘটনায় আরাফাত হোসেন নামের এক কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ।

থানা পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, নগরীর কলেজ রোড মীরবাড়ি এলাকায় নিহত সামিউল হক সামি ও একই এলাকার তার বয়সী কিশোরদের একটি বন্ধু গ্রুপ বিভিন্ন সময় রেললাইনে বসে আড্ডা দিত। ঘটনার দিন রাতেও তারা সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের মধ্যে হঠাৎ কথা কাটাকাটি হয়। ঘটনার একপর্যায়ে সামিউলকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শামীম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই দিনে জেলায় চার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা তদন্ত করছি। চারটি মামলার মধ্যে তিনটি মামলাতেই আসামি গ্রেপ্তার রয়েছে। পলাতক আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে। এসব ঘটনায় যারা জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।

তবে একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আনন্দ মোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মূলত পারিবারিক সম্পর্ক দুর্বল হওয়া, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় এবং আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে মানুষ। এ থেকে উত্তরণ পেতে হলে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষাটা প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীসহ তরুণরা আরও বেশি নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে পারবে বলে আমি মনে করি। সন্তানকে সামাজিকীকরণ করে গড়ে তুলতে পরিবারকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি মাদকের যে সহজলভ্যতা রয়েছে তা দূর করতে হবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারকেই আরও বড় ভূমিকা রাখতে হবে।

উবায়দুল হক/এমজেইউ