প্রায় ২১ বছর বন্ধ থাকার পর ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানাটি সচল হয় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। নতুন উদ্যমে কারখানা চালু হওয়ায় স্বপ্ন বোনেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচার আশা তৈরি হয়। কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতেই আবারও বন্ধ হয়ে গেছে কারখানাটি। গত বছর ৩ আগস্ট ঢাকঢোল পিটিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানাটি চালু করা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কারখানাটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। 

এ বিষয়ে কারখানার ম্যানেজার মো. তুষার বলেন, ছয় মাসে আমাদের কারখানায় দুই হাজার গজ শাড়ি এবং ৩০০ গজ পাঞ্জাবির কাপড় উৎপাদন করা হয়েছে। আমরা বাহিরের মার্কেট ধরতে পারিনি। যেহেতু দীর্ঘদিন ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানাটি বন্ধ ছিল সেজন্য এটি চালু হয়েছে অনেকেই জানেন না। আমরাও এখনো মার্কেট তৈরি করতে পারিনি। যার জন্য আমাদের যে পরিমাণ কাপড় উৎপাদন হয়েছে তা এখানে রেখে দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কিছু কাপড় আমরা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছি। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে কোনো ধরনের বাজার এখনো আমরা তৈরি করতে পারিনি। সেই জন্য আমাদের কারখানাটি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে আমরা খুব তাড়াতাড়ি উৎপাদনে ফিরে আসবো। ইতোমধ্যেই আমাদের ডিজিএম মেহেদী হাসান ভাই বাহিরে কিছু স্যাম্পল পাঠিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন বাজারে যেন এই রেশম কাপড় বিক্রি করতে পারি সেই চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সুপ্রিয় গ্রুপের মালিক মো. বাবলু বলেন, আমাদের রেশম কারখানাটি চালু করেছিলাম। কিন্তু বাজার ভালো না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে এই কারখানাটি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে রেখেছি। আমাদের শুধু এই কারখানা নয়, অন্যান্য যে কারখানা রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে এটা কোনো স্থায়ী বন্ধ  করে রাখা হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি আবার আমরা উৎপাদনে ফিরব। আমরা যদি মার্কেটটা ধরতে পারি তাহলেই আমরা উৎপাদনে ফিরে আসব।

তিনি বলেন, আমি  যখন রেশম কারখানাটি  উদ্বোধন করি,  তখনই বলেছিলাম আমরা এখান থেকে কোনো প্রকার ঋণ নিব না। তাই আমাদের রেশম কারখানার ওপর কোনো প্রকার ব্যাংক ঋণ নেই।

ঠাকুরগাঁও জোনাল রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক মো. মাহবুব-উল-হক বলেন, ‘সুপ্রিয় গ্রুপের’ মালিক শর্ত ভঙ্গ করে কারখানার উৎপাদন হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়েছেন। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। 

রেশম বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস ১৯৭৫-৭৬ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের গোবিন্দনগর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এলাকায় ৩ দশমিক ৩৪ একর জমির ওপর এই রেশম কারখানাটি স্থাপন করে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ১৯৮১ সালের ৩০ জুন কারখানাটি রেশম বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার নতুন যন্ত্রপাতি কিনে কারখানাটি আধুনিকায়ন করে। লোকসান থাকলেও কোম্পানিটি তখন ভালোই চলছিল। কিন্তু মূলধন না থাকার কথা বলে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর কারখানাটি বন্ধ করে দেয় বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার। 

ওই সময় কারখানায় কর্মরত ১৩৪ স্থায়ী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। পাশাপাশি বিপাকে পড়েন আরও প্রায় পাঁচ হাজার পলু পোকা চাষি (সুত উৎপাদনের জন্য তুঁতগাছ চাষ করেন যারা)। এ সময় আন্দোলন করেও কারখানাটি চালু করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওবাসী। বাজার না পেয়ে এ অঞ্চলের পলুচাষিদের অনেকেই চাষ কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলেও কারখানাটি আর চালু হয়নি। 

 ২০১৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আওয়াল কারখানাটি চালুর যৌক্তিকতা দেখিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ১১ সদস্যের একটি দল ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল কারখানাটি পরিদর্শন করেন। তারা কারখানার যন্ত্রপাতি পরিদর্শন করে কারখানা চালুর উপযোগী কিনা, তা ঘুরে দেখেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিমও মন্ত্রণালয়ে কারখানা চালুর যৌক্তিকতা তুলে ধরে চিঠি দেন। ২০১৯ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে তিনি বিষয়টি উপস্থাপনও করেন। পাশাপাশি সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে কারখানাটি চালু করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন। 

রেশম কারখানাটি চালু করার বিষয়ে ২০২১ সালের ২২ মার্চ জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে এক মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে রেশম বোর্ডের তৎকালীন মহাপরিচালক মু. আবদুল হাকিম বলেন, বোর্ডের জনবল সংকট রয়েছে। যত দিন জনবল নিয়োগ না হবে, তত দিন কারখানাটি চালাতে পারবেন না। এ জন্য তারা মাসিক বা বার্ষিক ফি নিয়ে ব্যক্তি খাতে দিতে চান। এই আলোচনার পর স্থানীয়ভাবে কয়েকজন কারখানাটি পরিচালনার আগ্রহ দেখান। কিন্তু পরে সেই উদ্যোগ থেমে যায়। অবশেষে কারখানাটি বেসরকারি পর্যায়ে বরাদ্দের জন্য দরপত্র আহ্বান করে রেশম বোর্ড। অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য ৫ বছর মেয়াদে ৮ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে কারখানা পরিচালনার সুযোগ পায় ঠাকুরগাঁওয়ের ‘সুপ্রিয় গ্রুপ’। 

ঠাকুরগাঁও রেশম কারাখানায় বর্তমানে ২০টি রিলিং মেশিন, ১৬টি হ্যান্ডলুম, ২০টি পাওয়ার লুমসহ প্রায় সব যন্ত্রাংশ সচল রয়েছে। 

কারখানা বন্ধ প্রসঙ্গে সুপ্রিয় গ্রুপের ডিজিএম মেহেদী হাসান বলেন, উৎপাদিত কাপড় বিক্রি হলে আবার কারখানা চালু করা হবে।

আরিফ হাসান/আরএআর