‘রানা প্লাজায় দেয়াল ধসে পড়ে আমার ডান পায়ের ওপর। সেসময় ২২টি মেডিকেলে আমি গিয়েছি। ১১ বার আমার পায়ে অপারেশন করা হয়েছে। চিকিৎসা করে সুস্থ্য হতে পারিনি। এখন পঙ্গুর মতোই চলাফেরা করতে হয়। কারণ যে টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম তা ওই সময়ই চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন ফুটপাতে সিগারেট বিক্রি করি, এখন আর চিকিৎসা করাতে পারি না।’ 

কথাগুলো বলছিলেন রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে আহত নিলুফা বেগম। বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে নিহতদের স্মরণে ফুলের শ্রদ্ধা জানাতে এসে এই প্রতিবেদকের কাছে দুঃসহ জীবনযাপনের কথা বলেন। 

নিলুফা বেগম বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা যখন ভেঙে পড়ে তখন ৫ তলায় কাজ করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ, অন্ধকার হয়ে গেল ফ্লোর। এর সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে আমাকে উন্নত  চিকিৎসার জন্য এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেখানে আমার পায়ে অপারেশন করা হয়। অপারেশন শেষে ডাক্তার বলেন, আমার দুই কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। এরপর চিকিৎসার জন্য ঢাকা কিডনি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এভাবেই ৭ বছর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে গিয়েছি। আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন শুধু আল্লাহকে ডাকতাম আর বলতাম, আমার ছেলেটাকে আল্লাহ এতিম করো না। 

পারিবারিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় ২০১৮ সালে স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।  ইচ্ছে ছিল ছেলেটাকে পড়াশোনা করাবো। কিন্তু টাকার অভাবে কিছুই করাতে পারিনি। আমি সাভার বাসস্ট্যান্ডে সিগারেট বিক্রি করতাম। এখন পুলিশ এসে বন্ধ করে দিয়েছে। 

রানা প্লাজার সামনে স্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণের দাবি জানিয়ে নিলুফা বেগম বলেন, একা ঘরে ঘুমাতে পারি না। যেকোন একটি শব্দ হলেই ভয় লাগে। রানা প্লাজায় এক হাজারেও বেশি মানুষ মারা গেছে। এখন জায়গাটাকে নর্দমা করে রাখছে। মানুষ এসে এখানে পায়খানা-প্রসাব করে। আমার কানে এখনো শ্রমিকদের চিৎকারের শব্দ শুনতে পাই। এই জায়গাটা ডাস্টবিন বানিয়েছে। জায়গাটাকে পরিষ্কার করে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হোক ও পবিত্র রাখা হোক। 

এদিকে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।
বুধবার সকালে থেকেই সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান নিহতদের স্বজন, আহত শ্রমিক, বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।

এ সময় উপস্থিত শ্রমিকরা সরকার ও কারখানা কর্তৃপক্ষের নিকট বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। তারা বলেন, রানা প্লাজার জায়গা ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে হতাহত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পুনর্বাসন করতে হবে। এখনো অনেক আহত শ্রমিক রয়েছে তাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা দরকার। রানা প্লাজার সামনে স্থায়ীভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও শ্রমিকদের এক জীবনের আয়ের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও নিহতের স্বজন ও আহতরা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে। যাতে প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৬ জন। প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক পোশাক শ্রমিককে।

আরএআর