প্রায় ১৫ বছর আগে সুন্দরবনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন বরগুনার পাথরঘাটার মো. আবুল কালাম। সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি। সেদিনের পর থেকেই কালামকে এলাকাবাসী নাম দিয়েছেন বাঘা কালাম। 

তবে বাঘের মুখ থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও শরীরে বিভিন্ন যায়গায় রয়ে গেছে ক্ষত চিহ্ন। দুই হাতের মধ্যে বাম হাতটি যেন তার থেকেও নেই। এক প্রকার অচল হয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছেন বাঘা কালাম। 

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদোয়ানি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের কাঁঠালতলী নামক এলাকার বাসিন্দা আবদুল কালাম। এক সময় তিনি বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করতেন। কাঠ বিক্রির টাকায় স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই ছিলেন কালাম। তবে তার জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু হয় ২০০৯ সালে। নিয়মিত বনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন তিনি। ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরলেও টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসা করাতে না পেরে অচল হয়ে যায় তার বাম হাত। এরপর থেকেই শুরু হয় কালামের জীবন যুদ্ধ। 

দীর্ঘ ১৫ বছর আগে বাঘের আক্রমণের শিকারের পর বাঘা কালাম কেমন আছেন তা জানতে সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার স্ত্রী সাজেদা বেগমকে নিয়ে একটি কাঠের ভাঙা ঘরে বসবাস করছেন কালাম। তিনি নিজে কিছুই করতে পারেন না। তাই তার স্ত্রী কাজ করেন এলাকার বিভিন্ন মানুষের বাসায়। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই ছেলে যে যার মতো আলাদা থাকেন। এদের মধ্যে বড় ছেলে থাকেন চট্টগ্রাম। আর ছোট ছেলেও বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বাইরে। 

বাঘের আক্রমণের সেই ঘটনার বর্ননা দিয়ে বাঘা কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাঠ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে আমি প্রথমে বনবিভাগের অফিসে যাই। তবে সেদিন মন ভালো না থাকায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। তখন অফিসার আমাকে বলে কাজে এসে আবার ফিরে যাবেন কেন? ওই দিন অফিস থেকে ভাত খেয়ে কাজে যেতে বলে। পরে অফিস থেকে ভাত খেয়ে বনে গিয়ে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করতে শুরু করি। এ সময় হঠাৎ করে বনের মধ্য থেকে একটি বাঘ আমার সামনে চলে আসে। তখন একমাত্র আল্লার উপর ভরসা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমার বাম হাতের গোড়ার অংশে বাঘ কামড়ে ধরে। হাত দিয়ে শরীরের সব রক্ত বের হওয়া শুরু করে। এভাবে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে থেকে পা দিয়ে আমার মাথায় আক্রমণ করে। এ সময় আমি মনে মনে শুধু আল্লাহকে বলি, আল্লাহ তুমি ছাড়া তো আমাকে বাঁচানোর কেউ নেই। একপর্যায়ে দেখি বাঘটি আমাকে ফেলে একটু দূরে চলে যায়। এরপর আমার ডাকচিৎকার শুনে এক সঙ্গে কাঠ সংগ্রহ করতে আসা আমার এক ভাই ছুটে আসে। এছাড়া বন বিভাগের অফিস কাছেই থাকায় অফিসের লোকজন টের পেয়ে বন্দুক দিয়ে ফায়ার করলে বাঘ দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে বনবিভাগের সহযোগিতায় আমার শরীরের ক্ষত অংশ গাছের পাতা দিয়ে বেঁধে নৌকায় উঠিয়ে তাদের অফিসে নিয়ে যায়। পরে চিকিৎসা নিতে পাথরঘাটায় পাঠালে দ্রুত আমাকে বরিশালে পাঠানো হয়। টাকা পয়সা না থাকায় এলাকার মানুষের সহযোগিতায় ১ মাস ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে আসি।

কালাম বলেন, আমি মানুষের কাছে কিছু চাইতেও পারি না। কোনো জায়গা থেকে অথবা কেউ আমাকে তেমন কোনো আর্থিক সহযোগিতাও করে না। যখন হাতের ব্যথা শুরু হয় তখন টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। বাড়ির পাশের বাজারে গিয়ে বসে থাকি, ফিরিয়ে দেওয়ার ভয়ে কারো কাছে কিছু চাই না।  

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কিভাবে তার সংসার চালছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এক হাত অচল থাকায় আমাকে তো কেউ কাজে নেয় না। তরপরেও মানুষের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করলে এক-দুইশ টাকা পাই। এছাড়া আমার স্ত্রী মানুষের বাসায় কাজ করে যে টাকা আয় করেন তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।

কালামের বিপদের সময়ে এগিয়ে আশা বাড়ির পাশের এক প্রতিবেশী ইসমাইল আকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালামকে বাঘে আক্রমণ করার পরে এলাকাবাসী সবাই মিলে টাকা পয়সা দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছি। এখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ছেলেরাও তার পাশে নেই। আছে এক মেয়ে সেও তাকে তেমন কিছু দিতে পারে না। এ অবস্থায় কালামকে যদি কেউ সহযোগিতা করে, অন্তত একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে তার উপকার হয়।

কালামের আরেক প্রতিবেশী সুমন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালাম ভাইয়ের দুইটা সন্তান কোথায় তাও আমরা জানি না। সমাজের মানুষ সবাই মিলে তার চিকিৎসা করালেও এখন বর্তমানে তাদের তিনবেলা খাওয়াই জোটে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাবে কিভাবে।

কালামের স্ত্রী সাজেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালাই। যখন যা পাই তখন তা দিয়ে আমরা চলি। আমাদের দেখারতো কেউ নাই। চেয়ারম্যান মেম্বাররা মাঝে মধ্যে সাহায্য করেন আবার অনেক সময় কিছুই দেন না। বয়স হয়ে গেছে। এখন আর মানুষের বাসায় কাজও করতে পারি না। কাজ করে যা পাই তা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য ওষুধই কিনতে পারি না।

এ বিষয়ে চরদোয়ানি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার জাহাঙ্গীর হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দা কালাম প্রায় ১৫ বছর আগে সুন্দরবনে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন। আমি এ ওয়ার্ডের দুইবার নির্বাচিত ইউপি সদস্য হিসেবে তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেছি। ভবিষ্যতে যদি ইউনিয়ন পরিষদে কোনো বড় ধরনের সহযোগিতা আসে তাহলে তাকে তা প্রদান করা হবে।

আব্দুল আলীম/আরকে