আল্লামা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী ওরফে কায়েদ সাহেব হুজুর

২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল লাখো ভক্তকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান দক্ষিণ বাংলার মহান সুফি সাধক ও ইসলামি স্কলার আল্লামা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী (কায়েদ সাহেব হুজুর)। হিন্দু-মুসলিম জনতার ঢলে সেদিন ১০ বর্গমাইল এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।

কায়েদ সাহেবের জানাজায় পাঁচ লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছে বলে ওই বছরের ৩০ এপ্রিল দেশের সব জাতীয় দৈনিকে খবর এসেছিল। ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে ২৯ এপ্রিল দুপুরে জানাজার আগ পর্যন্ত ফ্রিজিং গাড়িতে রাখা কায়েদের লাশ দেখতে মুসলিমদের সঙ্গে হিন্দুরাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঝালকাঠির মানুষের কাছে কায়েদ সাহেব সর্বকালের সর্বপ্রিয় কেন তা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন অধ্যাপক পার্থ সারথী, রমা দাস, শ্রী চাঁঁদ মোহন কংশ বণিক, অধ্যাপক ডা. অসীম কুমার সাহাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীর ৩৫ বিশিষ্ট নাগরিক। 

এছাড়া সভা-সেমিনারে বক্তৃতা বা লেখায় ঢাবির বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফাদার তপন ডি রোজারিও, ঝালকাঠির সাবেক জেলা প্রশাসক বিমল কুণ্ড, আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশের সভাপতি ড. সুকোমল বড়ুয়া কায়েদ সম্পর্কে যা বলেছেন তার সংক্ষেপ হলো, ‘মহাপুরুষরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন না, তার জীবন আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণীয়।’

কবি ফররুখ আহমদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. মু. মুস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আখতার ফারুক, ঢাবির আরবি সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আ র ম আলী হায়দার, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদসহ অনেকের লেখা থেকে জানা যায়, কায়েদ ছিলেন একাধারে দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, লেখক-গবেষক, চিকিৎসক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রূপকার।

কায়েদ সাহেব হুজুর

সনাতন ধর্মাবলম্বী বিশিষ্ট নাগরিকদের বলা একটি ঘটনা অনুযায়ী, বনেদি এক হিন্দুর ঘরে গিয়ে মাঝে মাঝেই নামাজ পড়তেন কায়েদ সাহেব। কায়েদ সাহেব ও তার দলবলের জন্য এ কারণেই বারান্দায় একটি কার্পেট প্রস্তুত রাখতেন সেই ঘরের গৃহকর্ত্রী তথা মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের নারী মুক্তিবাহিনীর প্রধান রমা রানী দাস।

বাড়ির কর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক পার্থ সারথী দাস বয়সে অনেক ছোটো হলেও কায়েদ সাহেব তাকে দোস্ত বলে ডাকতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে দোস্ত বানানোয় তার জাত নষ্ট হয়েছিল কি না, সেটি জানা যায়নি।

বর্ষার সময় বাড়ির সামনে পানি থাকলে পা ডুবিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হতো। সে রকম একদিন কায়েদ সাহেব আসার পর পার্থ সারথী অবাক হয়ে বললেন, আপনি এই পানির মধ্য দিয়ে আসছেন! কায়েদ বলেছিলেন, ‘দোস্তের বাড়ি দোস্তে আসবে, পানিতে করবে কী?’ পানিতে কেন, পৃথিবীর কোনো কিছুই এ সম্পর্ককে আলাদা করতে পারেনি বলে জানান পার্থ।

সফরসঙ্গীসহ এসে বাড়ির পুকুরের ঘাটলায় বসতেন কায়েদ। গাছের পাকা কাঁঠাল ভেঙে সবাই মিলে খেতেন। আম খেতেন। লেবু ছিঁড়ে শরবত বানাতেন। রমা দাসের কাছে কাউকে পাঠাতেন এই বলে ‘যাও ভাবি সাবের কাছ থেকে জগ, পানি ও চিনি নিয়ে আসো।’ আনার পর শরবত বানিয়ে সবাইকে খাইয়ে আবার ভাবি সাবের জন্য শরবত পাঠিয়েও দিতেন।

পার্থ-রমা দম্পতির বইয়ের আলমারিতে যতো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বই ছিল সব খুঁজে খুঁজে পড়তেন তিনি। তাল-লয়ে সুরে সুরে গেয়ে উঠেন। কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে ভাবি সাবের কাছে কাউকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে নিতেন।

কায়েদ সাহেব হুজুর

একবার ঝালকাঠি হরিসভায় হিন্দুদের কীর্তন হতে দেবে না- এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু অল্প শিক্ষিত মৌলভি ও মুসল্লিরা ওত পেতে ছিল। পার্থ সারথী এ কথা কায়েদ সাহেবকে জানানোর পরে কায়েদ নিজে হরিসভার সামনে সারারাত বসে থাকেন। তার ভয়ে কোনো বিশৃঙ্খলাকারী সামনে আসতে পারেনি।

কায়েদ সাহেব সমাজ সংস্কারমূলক যতগুলো সংগঠন ও কমিটি করেছিলেন সবগুলোতেই পার্থ সারথীকে রেখেছিলেন। হজ থেকে জমজমের পানি এনে বোতল ভরে পার্থর বাড়িতে পাঠিয়েছেন। কায়েদ নিজের মাদরাসায় ইংরেজি ও গণিতের ক্লাস নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে এনেছিলেন অধ্যাপক সারথীকে।

পার্থ সারথীর ছেলের একটি খেলার গাড়ি ছিল। একজন উঠে চালানোর মতো ব্যাটারিযুক্ত গাড়ি। গাড়িটি নষ্ট অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কায়েদ বললেন, এটি আমার খানকায় নিয়ে রাখব। পার্থ-রমা অবাক হলেও গাড়িটি নিয়ে খানকাহর সামনে রেখে ছিলেন তিনি।

একবার কীর্তন শোনার আয়োজন করেছিলেন কায়েদ তার নেছারাবাদ মসজিদের সামনে। পার্থকে অনুরোধ করে তিনজন কীর্তন শিল্পীকেও এনেছিলেন। তাদের মুখে সারারাত কীর্তন শুনে তাদের বখশিশও দিয়েছিলেন।

এভাবে কায়েদ তার জীবনকালে নকুল কুমার বিশ্বাসের সমাজ সংস্কারমূলক গানগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেছেন এবং সবাইকে নিয়ে গেয়েছেন। রবি ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’র মতো গানগুলো তিনি পছন্দ করতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কায়েদ সাহেবের কাছে পাক-হানাদারদের ভয়ে কয়েকজন হিন্দু ধর্মান্তরিত হতে এসেছিলেন। আত্মরক্ষার জন্য তখন দিকে দিকে ধর্মান্তরের হিড়িক পড়ে।

কিন্তু কায়েদ তার অসাম্প্রদায়িক নীতি বজায় রেখে সবাইকে বলেছিলেন, ‘মুসলমানও নিহত হচ্ছে; হিন্দুও হচ্ছে। যদি হায়াত থাকে, হিন্দু হলেও বাঁচবেন। বাঁচা-মরা তো কেবল আল্লাহর হাতে।’ এই বলে নতুন আশা দেখিয়ে হিন্দুদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ও এর পরে ঝালকাঠির বাসন্ডা গ্রাম-সংলগ্ন বাড়ৈ বাড়ির অনেক পানচাষির জীবন বাঁচিয়েছেন কায়েদ সাহেব। যুদ্ধের পরে এনিমি প্রপার্টি ও ডিক্লেয়ারেশনের নামে চলা দখলদারিত্বে ভয় পেয়েও অনেক হিন্দু বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছে। জমির দামের আশাও করেননি। কায়েদ মাদরাসার প্রয়োজনে রাখা কিছু জমির ন্যায্য দাম সেই হিন্দুদের শোধ করেছিলেন।

কায়েদ সাহেবের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড 

মুসলিম উম্মাহ ও সমাজ সংস্কারের জন্য প্রায় ১০০টি বই লিখেছেন। ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা বোর্ডের পরিকল্পনার অনেক আগেই মহিলা মাদরাসা গড়েছেন। সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয়, এতিমখানা, হেফজখানাসহ মাদরাসা কমপ্লেক্সে ছোট বড় ৫২টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত করেছেন।

মুসলমানদের দলাদলি নির্মূলে ‘আল ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ-মতানৈক্যসহ ঐক্য’ নীতির প্রবর্তন করে একাধিকবার ছারছীনা ও ঝালকাঠিতে সব দলকে একমঞ্চে বসিয়ে ইসলামি মহাসম্মেলন করেন।

১৯৬০ সালে দারুল ক্বাযা (সালিসি আদালত), ১৯৭৪ সালে দুর্নীতি উচ্ছেদ কমিটি, ১৯৯০ সালে আদর্শ সমাজ বাস্তবায়ন পরিষদ এবং ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ হিযবুল্লাহ জমিয়াতুল মুছলিহীন।

আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণীয় আল্লামা কায়েদের জীবনী

চায়ের বিকল্প 'জোশেন্দায়ে আযীযী' (মেহেদি পাতার চা) উদ্ভাবনসহ ভেষজ উদ্ভিদের সফল অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। আল্লামা কায়েদ প্রতিষ্ঠিত এনএস কামিল মাদরাসা দাখিল (এসএসসি) ও আলিম (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলে বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করছে বছরের পর বছর।

কায়েদ সাহেব মাত্র ৭ বছরে বাবাকে হারিয়ে শত কষ্টের মাঝেও সুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন শৈশব থেকেই। কলকাতা আলিয়া থেকে পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে ফলাফলে স্বর্ণপদক পেলেও অহেতুক ফতোয়াবাজি করতেন না।

বর্তমানে বাসন্ডা গ্রামের এলাকা ও সড়কগুলো গড়ে উঠছে কায়েদের নামকরণে। কিন্তু কায়েদের অসাম্প্রদায়িক আদর্শ হারিয়ে যাচ্ছে বলে কবি কামিনী রায়ের স্মৃতিচিহ্নও ধ্বংস করতে পারছে দখলদাররা, এমনটাই মত বীর মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী দাসের।

তিনি শুনেছেন, ১৯১১ সালে জন্ম নেওয়া আল্লামা কায়েদ সাহেব হুজুর ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীকাল জীবনে যদি কখনও দেখেছেন কোনো কীটপতঙ্গ পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে তাও তিনি পানিতে নেমে ওই প্রাণীদের উপরে তুলে এনেছেন। 

কায়েদ সাহেবের প্রিয় এক ছাত্র ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ বলেন, কায়েদ সাহেব একজন আল্লাহর ওলি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হুজুরের জন্য দোয়া করি আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুক।

এমএসআর