অনেক দিন ধরে এক চালার ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকি। ঘরের চারপাশ ও টিনের চালায় ফুটোর অভাব নেই। বৃষ্টি হলেই টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে ঘরে। ভেসে যায় মেঝে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ি রাতের বৃষ্টিতে। তখন আর শুয়ে থাকা যায় না।

সবাই মিলে রাত জেগে তখন পানি পরিষ্কার করি। কখনও কখনও পানি মুছতে মুছতে সকাল হয়ে যায়। ওই রাতে আর ঘুমাতে পারি না। একই ঘরে আমাদের ৮ জনের সঙ্গে দুটি গরুও থাকে। তিন প্রজন্ম ধরে এভাবেই চলছে আমার। 

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আপার কাগাবলা ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের বৃদ্ধা হালিমা খাতুন এভাবেই তার মানবেতর জীবন-যাপনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ওই ঘরে ছেলে, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও তিন ছেলেসহ তিনি থাকেন।  

তিনি বলেন, জীবনের ৮০ বছর পার করলাম এক ঘরেই। এ ঘরেই সন্তানদের বড় করেছি। একটাই ছেলে আমার। সেও তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকে এই ঘরে। অভাবের কারণে ছেলেটাকে পড়ালেখা শেখাতে পারিনি। দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছে সে। তার টাকা স্ত্রী সন্তানরাই ঠিকমতো খেয়ে পায় না, আমাকে কীভাবে খাওয়া? ছেলেটা এখন অসুস্থ। তারপরও কাজকর্ম করছে। সেও তার ছেলেদের পড়ালেখা করাতে পারেনি। 

সরেজমিনে রামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একই পরিবারের তিন প্রজন্মের সবাই বসবাস করছেন একটি ছোট কুঁড়ে ঘরে। ঘরের মাঝখানে একটি বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আরেকটি কক্ষ। সেখানেই থাকে দুটি গাভি। অপরকক্ষের এককোণায় একটি চুলা। চুলার পাশেই একটি চৌকি। 

হালিমা খাতুন এ বাড়িতেই জীবন পার করছেন। বতর্মানে তার একমাত্র ছেলেটিও অসুস্থ। তাই কাজে যেতে পারছে না। বড় নাতি পারভেজের কাঁধে এখন সংসারে বোঝা। ১৫ বছর বয়স থেকেই শুরু হয়ে গেছে তার জীবনযুদ্ধ। 

পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলে, বাবা অসুস্থ থাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি দিনমজুরের কাজ শুরু করছি। দৈনিক যা টাকা আসে সেটা দিয়েই সংসার চলছে। 

পারভেজের মা দিনা বেগম বলেন, খুবই অভাবে আমাদের দিন যাচ্ছে। স্বামী অসুস্থ থাকায় কাজ করতে পারে না। আমরা আটজন মানুষ একটা ঘরে থাকি। সঙ্গে দুইটা গরুও থাকে। আজ বিশ বছর ধরে এ ঘরে বসবাস করছি। ঝড় তুফান আসলে ঘরে বৃষ্টি পড়ে। এ নিয়েই দিন কাটছে। 

হালিমা খাতুনের প্রতিবেশী ফখরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারটি খুবই অসহায়ভাবে দিন যাপন করছে। ভাঙা ঘরে এতগুলো মানুষ বসবাস করে, যা অমানবিক। সমাজের বৃত্তবানরা যদি তাদের সহযোগিতা করেন তাহলে পরিবারটির মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে।

আপার কাগাবলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন দলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমার ওয়ার্ডে মাত্র ৪টি ঘর বরাদ্দ পেয়েছি। ঘরগুলো ইউএনও মহোদয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ হয়। কে ঘর পাবে, পাবে না তা তিনি তদারকি করছেন। যদি উনার নজরে পড়ে তা হলে, আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারব। 

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শরিফুল ইসলাম বলেন, সরকার যাদের ঘর বানিয়ে দিচ্ছে তারা একেবারেই ভূমিহীন ও ঘরহীন। সামনে যে ঘরগুলোর বরাদ্দ আসবে সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থান দেয়া হবে। 

এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। মৌলভীবাজারে প্রথম পর্যায়ে ১১২৬টি ঘরের বরাদ্দ এসেছে। দ্বিতীয় পর্যায়েও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি তালিকা চাওয়া হয়েছে। সরকারি এ ব্যবস্থাপনার বাইরেও ব্যক্তি ও সংস্থার কাছে আমরা আহ্বান করেছিলাম। এতেও আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। প্রায় দেড় শতাধিক ঘর ব্যক্তি ও সংস্থার অর্থায়নে নির্মাণের পর্যায়ে আছে। 

ওমর ফারুক নাঈম/এমএএস