যে কারণে ফরচুন সুজে শ্রমিক অসন্তোষ, আশ্বাসেও ভরসা নেই শ্রমিকদের
ফরচুন সুজের আন্দোলরত শ্রমিকদের সকল দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সন্ধ্যায় কারখানার সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের এই ঘোষণা দিয়ে ঘরে ফেরার আহ্বান জানান তিনি। বরিশাল জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় এই ঘোষণা দেন মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, আপনাদের (শ্রমিক) সকল দাবি মেনে নেওয়া হবে। শ্রমিকদের ওপর যে আনসার সদস্যরা গুলি বর্ষণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ আহত হলে তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব আমার। আপনারা কষ্ট না করে সকলে ঘরে ফিরে যান।
বিজ্ঞাপন
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মনদীপ ঘরাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বলেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কারখানার চেয়ারম্যান খুবই আন্তরিক। শ্রমিকদের গায়ে যদি আচড়ও লেগে থাকে তাদের সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব কারখারার চেয়ারম্যান নিয়েছেন। আপনারা শান্ত থাকুন। আপনাদের হয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করছেন।
ফরচুন সুজের চেয়ারম্যানের এই ঘোষণাকে ঘটনার আকস্মিকতা মোকাবেলা বলে দাবি করেছেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা।
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনরত শ্রমিক রুবেল বলেন, শ্রমিকদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়ে এখন আমাদের এখান থেকে সরাতে চাইছেন। আমরা সরে গেলে মিজান সাহেব ঘটনা ধামাচাপা দেবেন। আমরা বেতনও পাব না। এসবই যা বলে গেছেন তা সবই চালাকি।
আরেক শ্রমিক মনিরা বলেন, আমাদের বকেয়া বেতনসহ যে-সব দাবি করেছি তার বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না। ফরচুন সুজ আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। সব আইন ভেঙে অমানুষের মত পরিশ্রম করায়। কিন্তু প্রাপ্য টাকাও দেয় না।
শ্রমিকরা সর্বশেষ রাত ৮টায় কারখানার গেটে অবস্থান করে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছে।
শ্রমিক অসন্তোষের কারণ
আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু বকেয়া বেতনের দাবিতেই নয়, কারখানার মধ্যে আরও অনেক কর্মকাণ্ড ঘটান যেগুলো শ্রমিক আইনের পরিপন্থি। এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কারখানার মধ্যে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু ফরচুন সুজ কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কথা এড়িয়ে গেছেন। এমনকি যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন তাদের কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকুরিচ্যুত করা হতো।
চার বছর ধরে চাকরি করেন জেসমিন। তিনি বলেন, আমাদের ওভারটাইম করালেও কোম্পানি বিগত ৪/৫ বছর ধরে ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করেন না। তাছাড়া যে টাকা বেতন পাই তা থেকে শ্রমিক ফান্ডের নামে প্রতিমাসে ৪০০ টাকা কেটে রাখে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট। চাকুরি ছাড়লে বা চাকুরিচ্যুত হলে সেই টাকা পরিশোধ করে না ফরচুন।
সোনিয়া আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমাদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই। অন্য কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজ করালেও ফরচুনে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের মারধর করা হয় কারখানার মধ্যে।
আরেক শ্রমিক ইব্রাহিম বলেন, নির্ধারিত সময়ের একমিনিট পরে ঢুকলে বা সময় শেষ হওয়ার আগে বেড় হলেও ৪০ টাকা করে কেটে নিতো। আমাদের খুব ভোরে কাজে যোগ দিয়ে রাত ৯/১০টার দিকে কারখানা থেকে বেড় হতে হতো। কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কুকুর বিড়ালের মত আচরণ করা হয়। এসব কারণে শ্রমিকদের মধ্যে দিনে দিনে অসন্তোষ বাড়ে। আজকে আমরা বেতন চাইতে আসায় আনসার দিয়ে আমাদের ওপর গুলি করানো হয়। তারপর মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমাদের সরাতে চাইছে। শ্রমিকদের শরীরের রক্ষতো ঝড়েছেই। প্রয়োজনে শেষবিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও দাবি আদায় করে ঘরে ফিরব।
গুলিবিদ্ধ শ্রমিকদের ঢাকায় প্রেরণ
বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর ১০ রাউন্ড গুলি বর্ষণের কথা স্বীকার করেছে আনসার সদস্যরা। আনসার সদস্য ইউসুফ আলী বলেন, আমরা গুলি করতে বাধ্য হয়েছি। শ্রমিকরা আমাদের ব্যারাকে হামলা চালিয়ে ৬/৭ জন আনসার সদস্যকে মারধর করে। তারা আমাদের ম্যাগাজিন রুমে হামলা চালালে উপরের নির্দেশে গুলি করি।
আনসার সদস্যদের গুলিতে এখন পর্যন্ত আহত মোট ৫ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম জানান, হাসপাতালে ভর্তি শ্রমিক উজিরপুর উপজেলার নারায়নপুরের হানিফ সরদারের ছেলে মেহেদী (২৫), বাবুগঞ্জের রহমতপুরের গোলাম মোস্তফার ছেলে রাজি (২৫), পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ছারছিনা এলাকার শামসুদ্দোহার ছেলে তামিম (২০), গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের আব্দুল খালেক প্রমাণিকের ছেলে মিজানুর (২০), ঝালকাঠির নলছিটির বাসিন্দা খোকনের ছেলে রাফসান (২০)। এদের সকলের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
বাসদের কর্মসূচি ঘোষণা
ফরচুন কারখানায় বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখা। একই সঙ্গে বকেয়া পরিশোধসহ শ্রমিকদের সকল দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট। আগামী শনিবার (২৫ মে) বেলা ১১টায় অম্বিনী কুমার হলের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে সংগঠনটি।
বাসদ বরিশাল জেলার সমন্বায়ক ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ন্যায্য পাওনা চাইতে গিয়ে গুলি খাওয়ার মত ঘটনা শ্রমিকের ক্ষেত্রে আইনের শাসনের অনুপস্থিতিকেই প্রমাণ করে। দুই মাস ধরে বকেয়া বেতন-বোনাস না দিয়ে মালিক অর্ধমাসের বেতন দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, বেতন চাইতে গেলে শ্রমিকের উপর গুলি করার মত অমানবিক অত্যাচার করেছেন। আমরা এই হামলার বিচারসহ অবিলম্বে শ্রমিকের সকল বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ করার দাবি জানাচ্ছি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ