বাংলাদেশের রফতানি তালিকায় এক সম্ভাবনার নাম কুমির। বিশ্ববাজারে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করে কুমির চাষ। ইতোমধ্যে পাঁচবার কুমিরের চামড়া রফতানি করে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

তবে হতাশার কথা হলো, প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের ঋণের বোঝায় অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে খামারটির কার্যক্রম। সেই সঙ্গে বিশ্ব মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে গেল বছর কুমিরের চামড়া রফতানির খাতায় নাম লেখাতে পারেনি খামারটি। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে শতভাগ রফতানিমুখী এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য এখন টিকে থাকাই দায়।

জানা যায়, ভালুকা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে শালবনের ভেতর উথুরা ইউনিয়নের হাতিবের গ্রাম। গ্রামটি এখন পরিচিত কুমির গ্রাম হিসেবে। ২০০৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে ৭৫টি কুমির এনে ১৫ একর জায়গার ওপর বিশাল এ খামারটি গড়ে তোলে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া রফতানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

খামারটির ব্যবস্থাপক ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় কুমির। এর চামড়া রফতানিতে শীর্ষে রয়েছে জাপান। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে এ দেশটিতে রফতানি করা হয় ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া। প্রতিটি কুমিরের চামড়ার দাম গড়ে ৫ থেকে ৬০০ ডলার।

২০২০ সালে রফতানিযোগ্য প্রায় ৫০০ কুমিরের চামড়া থাকলেও তা রফতানি করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে আরিফ বলেন, করোনাকালীন চামড়ার বাজার মূল্য অনেকটা কমে গিয়েছিল। যে কারণে গেল বছর আমরা কুমিরের চামড়া রফতানি করতে পারিনি। এই মুহূর্তে আমরা একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছি। রফতানি না হওয়ায় আমাদের কিছু আর্থিক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় আয় থেকেই কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুব শিগগিরই এ পরিস্থিতি অতিক্রম করতে পারব।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চামড়া রফতানি না হওয়ার পেছনে করোনা পরিস্থিতি ছাড়াও মালিকানার ‘কু’ প্রভাব পড়েছে অপ্রচলিত রফতানিযোগ্য এ প্রতিষ্ঠানটিতে। বিশেষ করে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের মালিকানার বিষয়টি। তার ঋণের জাঁতাকলে এখন পিষ্ট খামারটি।

রেপটাইলস ফার্মের প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, খামারটি প্রতিষ্ঠার শুরুতে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের। আর ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল মুশতাক আহমেদের। তারা সম্পর্কে মামা-ভাগনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ প্রকল্পের ঋণ নেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৪৯ শতাংশ। সেই হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাংক কর্মকর্তা প্রীতিশ কুমার সরকার ছিলেন পরিচালক।

কুমিরের খাবার, বাচ্চা প্রজনন ও পরিচর্যার কাজে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে। তখনই মেজবাহুল হক ও মুশতাক আহমেদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। যা বাংলাদেশ ব্যাংক ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রীতিশ কুমার সরকারের পক্ষ থেকে মুশতাক আহমেদকে চিঠি দিয়ে অবগত করা হয়, ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেওয়ার জন্য টাকা জমা দিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ারের পুরোটাই মেজবাহুল হকের নামে হস্তান্তর করা হবে।

তখনই পিকে হালদারের সঙ্গে প্রীতিশ কুমার সরকারই মেজবাহুল হক ও মুশতাক আহমেদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। একপর্যায়ে ২০১২ সালে খামারের শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হন কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা মুশতাক আহমেদ।

২০১৩ সালের দিকে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রেপটাইলস ফার্মের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নেন পি কে হালদার, যা আর শোধ হচ্ছে না। আর্থিক খাতের আলোচিত এই ঋণখেলাপি পিকে হালদার পালিয়েছেন বিদেশে। এমনকি ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব সোমেরও এখন হদিস নেই। এসবেরই প্রভাব পড়েছে কুমির রফতানিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের সম্ভাবনাময় খাতটি বাঁচাতে প্রয়োজন যোগ্য কর্ণধার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব সার্জারি অ্যান্ড অবসটেট্রিকসের অধ্যাপক মো. রফিকুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠিত ফার্ম। আমি মনে করি, কোনো শিল্পোদ্যোক্তা কিংবা ধনাঢ্য ব্যক্তি যদি ফান্ডিংয়ের জন্য এগিয়ে আসেন অথবা সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে ফার্মটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

খামারটিতে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২ হাজার ৮০০-এর বেশি কুমির রয়েছে। এর মধ্যে প্রজননক্ষম কুমির আছে ১২০টি। কুমির চাষের পাশাপাশি এ খামার এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচ হাজার ফলদ ও বনজ গাছের সমন্বয়ে ছায়া-সুনিবিড় নৈসর্গিক পরিবেশও।

এনএ