তরুণ ও বেকার যুবসমাজের কাছে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ একটি অন্যতম আকর্ষণের বিষয়। কারণ, সীমিত জায়গা ও স্বল্প খরচে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়। ঠাকুরগাঁও জেলায় তরুণ ও যুবকদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া পড়েছে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে। তবে অনেকেই এখন লোকসানের মুখে আছেন।

সঠিক দিকনির্দেশনা, আর্থিক অভাব, প্রতারণার শিকার ও মাছের পোনার সঠিক পরিচর্যা না করায় অনেক মৎস্যচাষিকে হতে হয়েছে ক্ষতির সম্মুখীন। বসতে হয়েছে পথে। অধিক টাকা খরচ করেও যেন মিলছে না সঠিক সমাধান। অনেকে আবার ছেড়ে দিয়েছেন এই মৎস্যচাষ।

জেলার বিভিন্ন মাছচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ কারও কাছ থেকে শুনে, কেউবা ইউটিউব দেখে শুরু করে দেন এই মাছ চাষ। কিন্তু এর টার্ম বুঝতে না পেরে অনেকেই ক্ষতির মুখোমুখি হন। কোনো উপায় না পেয়ে এখনো লাভের আশায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। কেউবা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন এই বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছ চাষ।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সফল মৎস্যচাষিদের দাবি, স্থানীয়ভাবে বায়োফ্লাকের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এমন ক্ষতি হবে না আর কারোই। অন্যদিকে আগ্রহী চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার আশ্বাস দিলেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।

জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, সদর উপজেলায় ৩০ জন এই বায়োফ্লকের মাধ্যমে মাছ চাষ করছে। এ ছাড়া রানীশংকৈল উপজেলায় একজন ও পীরগঞ্জ উপজেলায় একজন রয়েছে। তবে হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার তেমন কোনো তথ্য যেন নেই তাদের কাছে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ এলাকায় বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছিলেন আবদুর রহমান। কিন্তু ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হন এই মৎস্যচাষি। আবদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুটি ট্যাংক, ত্রিপল, মাছের পোনা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম― সব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ টাকার মতো খরচ করেছি। প্রথমে কই মাছের পোনা ছেড়েছিলাম। পোনা ভালো না হওয়ায় ১৮ থেকে ১৯ হাজার পোনা মারা যায়। পরে আবারও মাছ ছাড়া হয়। 

তিনি বলেন, এরপর হঠাৎ বন্যার কারণে পানিনিষ্কাশনের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক মাছ চলে যায়। পরে আবারও কিছুদিন পর ব্লকে তেলাপিয়া মাছ ছাড়ি। তবে পোনা ভালো না পাওয়া ও মাছের দাম কম থাকায় ক্ষতি হয়ে যায়। দুই ধাপে এই মাছের পেছনে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

একদিকে মাছের ক্ষতি, অন্যদিকে ব্যবহৃত মোটরে বিদ্যুৎ বিল অনেক বেশি আসত। সব মিলিয়ে আমি এত টাকা খরচ করে মাত্র ৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে পেরেছি। ক্ষতি করে আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই বায়োফ্লক বন্ধ করে দিয়েছি। পরে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়েছি, বলেন আবদুর রহমান।

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি মাহাবুব হোসেন বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে বায়োফ্লকে মাছ চাষ শুরু করেছি। ইউটিউবে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। এরপর এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছি। প্রথমে ৩০ হাজার লিটারে শিং মাছের ১৭ হাজার পোনা ছেড়েছি। সঠিক পদ্ধতি না বোঝার কারণে আমার প্রায় দুই থেকে তিন হাজার মাছ মারা গেছে।

অন্যদিকে মাছের পোনার কিছুটা সমস্যার কারণে হয়তো লাভ করতে পারেননি। তবু আশায় আছেন জানিয়ে মাহাবুব বলেন, সেই সঙ্গে সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় আমার অনেক মাছ মারা গেছে। আমাদের যদি সরকারিভাবে কোনো ঋণের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে অনেক সুবিধা হবে। সেই সঙ্গে যদি এই বায়োফ্লকের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে সফল এক চাষি রায়হান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অল্প পরিসরে অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করা সম্ভব বায়োফ্লকের মাধ্যমে। শুরুতে আমি যে বিনিয়োগ করেছিলাম বায়োফ্লক তৈরিতে, তাতে আমি সফল। ছয় মাস আগে এটি শুরু করেছি প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয়ে। বতর্মানে খরচ তুলে নিয়েও আমি লাভের মুখ দেখেছি। একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আমি সফল বলে মনে করি।

তিনি বলেন, বায়োফ্লক করতে প্রথমে যেসব জিনিসপত্রের প্রয়োজন, সেগুলো নিজেকে গিয়ে কিনতে হবে। অন্যের ওপর নির্ভর করা যাবে না। অনেকেই এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন, যেটি আমি শুনেছি। তবে কেউ যদি কেউ সফল হতে চায়, তাহলে পোনা বাছাই করতে হবে। পোনা যদি ভালো জায়গা থেকে নেওয়া যায়, তাহলে একজন উদ্যোক্ত সফলতার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, তারপর পরিচর্যার বিষয়। এখানে প্রতি ১০ হাজার লিটার পানিতে কমপক্ষে হলেও ৪০০ থেকে ৪৫০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, কোনোভাবে যাতে এই বায়োফ্লকের পদ্ধতিতে অক্সিজেনের অভাব না হয়। যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, সে জন্য আগে থেকেই জেনারেটর কিংবা ব্যাটারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। সময়মতো খাবার দিতে হবে। মাছের আকার বুঝে ধাপে ধাপে আগাতে হবে। পানির তাপমাত্রা, অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

বায়োফ্লক করে সফল আরেক উদ্যোক্তা সাহেদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর আগে ছোট ভাইয়ের কাছে শুনেছি আরএস পদ্ধতিতে এই বায়োফ্লকের মাধ্যমে মাছ চাষ করা যায়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেওয়ার পরে নিজের উদ্যোগে শুরু করেছি। এই পদ্ধতিতে সফল হতে হলে প্রথমে দরকার সেটি হলো, পিএইচ (পানির ক্ষারত্ত) নিয়ন্ত্রণ করে কিছু টিডিএস (লবণ) দিয়ে তারপর মাছের পোনাগুলো ছাড়তে হবে।

তিনি বলেন, এরপর ধীরে ধীরে টিডিএসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে প্রথম অবস্থায় মাছগুলোকে দিনে তিনবার খাবার দিতে লাগে। যখন মাছটি বড় হয়ে যায়, তখন খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিনে দুবার খাবার দিলেই হবে। অক্সিজেনের (মাছ চাহিদামতো ৬-১০) ব্যবহার বুঝতে হবে। পানির তাপমাত্রা (২৫-৩০) নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

তারপোলিন, অক্সিজেন মেশিন, নেনো টিউব― এসব জিনিস বিভিন্ন দামে পাওয়া যায় জানিয়ে সাহেদ বলেন, এগুলো বুঝেশুনে নিতে হবে। তবে আমি মনে করি যদি জেলায় বায়োফ্লকের ওপর মৎস্য অধিদফতর থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে যারা এভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তারা হয়তো সঠিক পথে আসবেন।

তিনি জানান, অনেকে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেক তরুণ প্রতারকদের ভুল সিদ্ধান্তে পড়ে বিভিন্ন জিনিসের দাম বেশি দিয়ে কিনে শুরুতেই বেশি বিনিয়োগ করে বসেন। যে কারণে পরে তারা আর কুলিয়ে উঠতে পারেননি। একপ্রকার পথে বসে যাচ্ছেন। তাই যারাই এই বায়োফ্লক করতে চান, তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা নিয়ে আসতে হবে।

ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা খালিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, বায়োফ্লক এমন একটি পদ্ধতি, যেটা দিয়ে স্বল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন করা সম্ভব। সেই সঙ্গে লাভজনক একটি বিষয়। এটাকে মাথায় নিয়ে অনেক তরুণ-যুবক বায়োফ্লক বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে এখন অনেকইে সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, অনেকে জানেন না এটা কী পদ্ধতিতে করতে হবে। কেউবা ইউটিউবে দেখছেন, কেউবা বিভিন্নজনের কাছে শুনে করছেন। পরে যখন তারা বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছেন, তখন অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

এই বায়োফ্লক করতে বেশ কিছু বিষয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, যেমন অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া, উপকারী বেকটেরিয়া, আরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। এগুলো যখন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না, তখন অনেকেই ঝরে পড়ছেন। তবে এখনো বেশ কিছু সফল চাষি আছেন, যারা সব বিষয় বুঝে বায়োফ্লকে মাছ উৎপাদন করে যাচ্ছেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের বেশ কিছু কর্মকর্তা এই বায়োফ্লকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। আমার বিশ্বাস, যারা আগ্রহী চাষি রয়েছেন, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের নিয়ে একটা প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারব। ফলে তারা হয়তো আর ক্ষতির সম্মুখীন হবে না।

এনএ