শরীরে জোর নেই, তবু কাঠ কাটছেন বৃদ্ধ মশিরউদ্দি

৩০ বছর আগে নিজ জেলা থেকে এসে বসতি গড়েন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। দীর্ঘদিন ভিক্ষা করার পর এক ব্যক্তির সহায়তায় পান একটি কুড়াল। এই কুড়াল দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে কাঠ ফেঁড়ে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই চলে স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে সংসার। ২৮ বছর ধরে কুড়াল হাতে সংগ্রাম করা বৃদ্ধ মশিরউদ্দি হাঁটাচলা করেন কোনোমতে। ঠিকানা জটিলতার কারণে পান না সরকারি কোনো সুবিধা।

গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের আন্দিড়াপাড়া গ্রামের মৃত ওইসুদ্দি ব্যাপারীর দরিদ্র পরিবারে জন্ম মশিরউদ্দি। পারিবারিক দুরবস্থার কারণে দ্বিতীয় শ্রেণিতেই শেষ হয় পড়াশোনা। একদিকে নদীভাঙন, অন্যদিকে কোনো কাজকর্ম না থাকায় বিয়ের পর এক সন্তানকে নিয়ে আরও বিপাকে পড়ে যান মশিরউদ্দি। কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

জানা যায়, প্রায় ৭৫ বছর বয়সী মশিরউদ্দির জন্ম গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় হলেও নদীভাঙনের কবলে পড়ে ৩০ বছর আগে চলে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। স্থায়ী বাসস্থান না থাকায় কয়েক বছর রেলের বস্তিতে বসবাস করার পর প্রায় ১৫ বছর ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আলীনগরে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র না হওয়ায় ৩০ বছর ধরে বসবাস করেও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি মশিরউদ্দি ও তার পরিবার।

এখানে আসার পর তিন মাস অন্যের গরুর পালের রাখাল হিসেবে কাজ করেন। পরে কোনো কাজ না পেয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেন। পরে ভিক্ষা বাদ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য স্থানীয় এক ব্যবসায়ী আমজাদ আলীর শরণাপন্ন হন। তিনি মশিরউদ্দির হাতে একটি কুড়াল তুলে দেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না পেলেও এই একটি কুড়ালেই ভর করে ২৮ বছর ধরে সংসার চলছে মশিরউদ্দির।

কুড়ালটি পাওয়ার পর জেলা শহরের ফিটু ও দুরুলের খড়ির আড়তে এক বছর কাজ করেন মশিউদ্দি। তারপর নিজেই শুরু করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে খড়ি ফাঁড়ার কাজ। এতে এখন দৈনিক ৭০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পায়। ৩ ছেলের মধ্যে এক প্রতিবন্ধী ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলছে মশিরউদ্দির সংসার। আলীনগর এলাকার রবিউল ইসলাম মতির বাড়িতে মাসিক ১৫০০ টাকায় ভাড়া থাকে মশিরউদ্দির পরিবার।

মশিরউদ্দি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো কাজ না পেয়ে একসময় ভিক্ষা করেছি। কিন্তু ভিক্ষা করেও সে সময় তেমন চলতে পারতাম না। তাই এলাকার এক ব্যবসায়ীর সহযোগিতা ও পরামর্শে কুড়াল নিয়ে খড়ি ফাঁড়ার কাজ শুরু করি। বয়স অনেক হয়েছে, শরীরে আর কুলায় না। কিন্তু কী আর করার। সংসার চালাতে এই কষ্ট করতেই হচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানকার আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) কার্ড নাই, তাই মেম্বারদের (ইউপি সদস্য) দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সরকারি সহযোগিতা পাইনি। গাইবান্ধার স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে বারবার ধরনা দিয়েও একটা বয়স্কভাতা বা প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য কোনো সরকারি সহযোগিতা পাননি বলেও জানান তিনি।

মশিরউদ্দির এক প্রতিবেশী মরিয়ম বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা এখানেই বসবাস করেন। খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন। একপ্রকার খেয়ে না-খেয়ে দিন যায় তাদের। মেম্বার-চেয়ারম্যানরাও একটু সহযোগিতা করেন না।

স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল খালেক বলেন, আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত লজ্জার। কারণ, ৭৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ কুড়াল হাতে নিয়ে প্রতিদিন কাজ করছেন। মশিরউদ্দির প্রতি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আলীনগর এলাকার গৃহবধূ হাসিনা বেগম বলেন, কয়েক দিন আগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আলীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে লোকটি (মশিরউদ্দি) খড়ি ফাঁড়াচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলে আমার বাড়িতে খড়ি ফাঁড়তে ডেকেছি। এই বয়সে কাঠ ফাঁড়তে দেখলে খুবই মায়া লাগে। এই বয়সে তার বসে শুয়ে থাকার কথা থাকলেও, সংসার চালাতে গিয়ে এত কষ্টের কাজ করতে হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার যেকোনো একটা ব্যবস্থা করে দেব।

জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক উম্মে কুলসুম ঢাকা পোস্টকে জানান, এমন ব্যক্তি এই বয়সে কুড়াল হাতে কাজ করার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে বৃদ্ধ মশিরউদ্দিকে যেকোনো সরকারি সহায়তা নিতে হলে গাইবান্ধা থেকেই নিতে হবে। কারণ সেখানকার ঠিকানায় তার জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।

এনএ