করোনা মাহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী যখন অক্সিজেন-সংকট এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত তরল অক্সিজেন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে, ঠিক তখনই আশার আলো দেখাচ্ছে তরুণ উদ্যোক্তা নূরুজ্জামানের প্রতিষ্ঠা করা ‘নর্থ বেঙ্গল অক্সিজেন প্ল্যান্ট’। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যেও মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করতে চান এই তরুণ উদ্যোক্তা।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায় অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল অক্সিজেন প্ল্যান্ট’-এ পরীক্ষামূলকভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন শুরু হয়েছে। এটির এখনো সরকারের অনুমোদন হয়নি। অনুমোদন পেলে এই প্ল্যান্ট থেকেই পাওয়া যাবে মেডিকেল অক্সিজেন, যা সরবরাহ করা গেলে উত্তরাঞ্চলের সরকারি ও বেসরকরি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্তদের জীবন বাঁচাবে। নিরসন হবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে চলমান অক্সিজেন-সংকট।

গত বছর বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন উত্তরাঞ্চলে মেডিকেল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে প্ল্যান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন তরুণ উদ্যোক্তা নূরুজ্জামান। ২০২০ সালের আগস্টের মাঝামাঝি শাজাহানপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে ডোমনপুকুর এলাকায় ‘নর্থ বেঙ্গল অক্সিজেন প্ল্যান্ট' নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত এই প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ শেষ হয় চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি।

জানা যায়, গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের পরীক্ষামূলক উৎপাদন। এখানে দৈনিক ২ হাজার ৪৫০ ঘন মিটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদিত হচ্ছে। এই অক্সিজেন শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। গুণগত মান ভালো হওয়ায় সাড়া পড়েছে ব্যবহারকারী পর্যায়ে, যা ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, যাশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ব্যবসায়ীরা শাজাহানপুর থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন কেনা শুরু করেছেন।

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার ধুনট মোড়ে অবস্থিত মেসার্স আল্লাহর দান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমান উল্লাহ্ আমান ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ২৪ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন, মেডিকেল অক্সিজেন, অ্যাসিটিলিন, নাইট্রোজেন এবং আর্গন গ্যাসের ব্যবসা করছেন। বগুড়ার শেরপুর ও বগুড়া শহরের কলোনি এলাকায় তার প্রতিষ্ঠানের পৃথক দুটি ইউনিট রয়েছে। প্রতি মাসে তার চাহিদা প্রায় ৮০০ বোতল গ্যাস। তিনি এসব গ্যাস চট্টগ্রাম থেকে কিনতেন। শাজাহানপুরে প্ল্যান্ট চালু হওয়ার পর তিনি এখান থেকেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন কিনছেন। তার মতে, এখান থেকে গ্যাস কিনলে পরিবহন খরচ ও সময় দুটোই বাঁচবে।

ভারত থেকে আমদানি করা তরল অক্সিজেন সরবরাহের কোনো নিশ্চয়তা নেই। করোনা মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই ভারত অক্সিজেন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে শাজাহানপুরে নিজস্ব প্ল্যান্টে অক্সিজেন উৎপাদন হওয়ায় এই সরবরাহ বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে।

নর্থ বেঙ্গল অক্সিজেন প্ল্যান্টের জেলারেল ম্যানেজার ওমর ফারুক জানান, প্ল্যান্টে পরীক্ষামূলকভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন চলছে। সেই সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত সিলিন্ডারে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে মেডিকেল অক্সিজেনও উৎপাদন করা হচ্ছে। এসব মেডিকেল অক্সিজেন করোনা ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত দুস্থ রোগীদের বাড়ি বাড়ি বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত অর্ধশত পরিবারে বিনামূল্যে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, ব্যবসার পাশাপাশি মানবসেবার উদ্দেশ্যে তিনি অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন। পরিবেশ অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। দ্রুত অনুমোদন পাওয়া গেলে মেডিকেল অক্সিজেনের বর্তমান সংকট মোকাবিলায় তার প্ল্যান্ট জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, সরকার চাইলে করোনা মহামারি চলাকালে হাসপাতালগুলোয় তিনি বিনামূল্যে মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করবেন।

পরিবেশগত ছাড়পত্রের আবেদন পাওয়া গেছে উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে জানান, নর্থ বেঙ্গল অক্সিজেন প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষকে আবেদন-পরবর্তী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। কাগজপত্র পাওয়া গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বগুড়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আরএমও ডা. শফিক আমিন কাজল ঢাকা পোস্টকে জানান, বগুড়ায় যদি মেডিকেল অক্সিজেনের উৎপাদন হয়, তবে তা করোনার চিকিৎসার জন্য আশার বাণী। কারণ, করোনায় আক্রান্তদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অক্সিজেন।

এনএ