করোনাভাইরাসের মহামারিতে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ভিন্ন উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন বাসচালকরা। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার কারণে দেশে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাসচালকদের ভিন্ন পেশা বেছে নিতে হচ্ছে। বাসচালক মঞ্জুর রহমান তাদেরই একজন। জীবিকার তাগিদে সবজি পেশায় কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি এখন বেছে নিয়েছেন এই পেশা।

মঞ্জুর রহমানের (৪৫) বাড়ি উপজেলার ফসলান্দি গ্রামে। পেশা পরিবর্তন করে মঞ্জুর বর্তমানে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অস্থায়ী কাঁচাবাজারে সবজির দোকানদার।

ভূঞাপুর থেকে ঢাকাগামী হাইচয়েস পরিবহনের বাস চালাতেন মঞ্জুর। করোনাভাইরাসের কারণে দেশে লকডাউন ঘোষণায় বন্ধ হয়ে যায় সড়কে বাস চলাচল। এতে মঞ্জুর রহমানও বেকার হয়ে যান। মঞ্জুরের পাঁচজনের সংসারে রয়েছে স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মঞ্জুর ভূঞাপুর কাঁচাবাজারে সবজি বিক্রি করছেন। তার বাসে যিনি সুপারভাইজার ছিলেন, তিনিও তার সঙ্গে সবজি বিক্রিতে সহযোগিতা করছেন। দুজনে মিলেই এই দোকান পরিচালনা করেন।  দিন শেষে বিক্রি করে যে আয় উপার্জন হচ্ছে, তাদের সংসারের জন্য নিচ্ছেন।

মঞ্জুরের সহকারী মনিরুজ্জামান খোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে বাসের সুপারভাইজার ছিলাম। দেশে যে লকডাউন শুরু হয়েছে, তাতে কবে নাগাদ গণপরিবন খুলবে, সেটা কেউ বলতে পারছে না। লকডাউন শুধু বাড়ছেই। কিন্তু আমাদের কোনো আয় উপার্জন নেই। কেউ কোনো অনুদান দেয়নি। আমাদের শ্রমিক সংগঠন থেকেও কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। আমি ওস্তাদের (চালক) সঙ্গেই ছিলাম গাড়িতে। সেও গাড়ি চালাতে পারেছে না, আমারও কর্ম নেই। তাই বাধ্য হয়ে ভিন্ন পেশা হিসেবে সবজির ব্যবসা করছি। এতে যে উপার্জন হচ্ছে, তাতে সংসারও চলছে না।

একই বাজারের আরেক সবজি ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বলেন, এই বাজারে কয়েক বছর ধরে সবজি ব্যবসা করে আসছি। আমার পাশের দোকানদার আগে বাস চালাতেন। করোনার কারণে এখন তো বাস চলাচল বন্ধ। তাই তিনি এইখানে সবজির ব্যবসা করছেন। এতে কিছুটা হলেও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে পারবেন।

আরেক সবজি ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন বলেন, গাড়িচালক মঞ্জুর নতুন হিসেবে এই বাজারে সবজি ব্যবসা করছেন। এই সবজি ব্যবসার উপার্জনে সংসার চালানো খুবই কষ্ট হবে তার।

কথা হয় মঞ্জুর রহমানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, দেশে এখন করোনাকাল। এ কারণে দেশে লকডাউনের ফলে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্রায় দুই মাস বেকার ছিলাম। ফলে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে এই সবজি ব্যবসায় আসছি শুধু পরিবারের সদস্যদের মুখে দুই বেলা অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য।

চালকদের জন্য যে কল্যাণ ফান্ডের টাকা রয়েছে, সেখান থেকে কোনো টাকা পান কি না, এমন প্রশ্নে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কোনো সহায়তা করা হয়নি। ওই কল্যাণ ফান্ডের টাকা পাওয়া যাবে মারা যাওয়ার পর। তবে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যাতে ফান্ড থেকে আপাতত অর্ধেক টাকা দেওয়া হয়। আমরা এখন চলতে পারি না, মরার পর টাকা দিয়ে কী হবে?

তিনি বলেন, দেশে কবে নাগাদ লকডাউন শেষ হবে বা গাড়ি চলবে কবে, সেটা অনিশ্চিত। এই সপ্তাহ বন্ধ তো পরের সপ্তাহ শেষে আবার লকডাউন হচ্ছে। এতে দিনের পর দিন বসে ছিলাম। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো সহায়তা করেনি। সরকার বা আমাদের সংগঠন থেকেও কোনো আর্থিক সহায়তা করা হয়নি।

‘নিরুপায় হয়েই কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও সবজির ব্যবসায় এসেছি। বেকার থেকে কীভাবে চলব? কোথায় যাব? পাঁচজনের সংসার। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া খরচ ও খাওয়ার খরচ রয়েছে। যদি আবার গাড়ি সড়কে চলে, তাহলে আবার আমি গাড়ি চালাব।’ বলেন মঞ্জুর।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা বাস কোচ মিনিবাস শ্রমিক সংগঠনের ভূঞাপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক খন্দকার সুরুজ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড যেটা রয়েছে, সেটা মৃত্যুর পর ওই শ্রমিক সেখান থেকে অনুদান দেওয়া হয়। কোনো চালক বেকার হয়ে পড়লে কল্যাণ ফান্ড থেকে কোনো বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই বা এ জন্য কোনো ফান্ডও নেই।

কিন্তু বর্তমানে পরিবহনশ্রমিকরা অবহেলিত, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সড়কে অন্যান্য পরিবহন চলাচল করছে শুধু বাস ছাড়া। এ জন্য এই শ্রমিকরা খুবই কষ্টে দিন পার করছেন। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ভিন্ন উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ সবজি, কেউ ফল, কেউ সিএনজি চালাচ্ছেন।

দীর্ঘদিন পর প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা হিসেবে মোটরযান শ্রমিকদের জন্য চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী দিনে যেন নিয়ম মেনে বাস সড়কে চলতে পারে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন এই পরিবহন নেতা।

এনএ