রাসায়নিক দিয়ে পাকানো কাঁচা লিচু বাজারে

কুষ্টিয়া শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে অনেক ফল দোকানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাদামি রঙের লিচু। দেখতে পাকা লিচুর মতো। কিন্তু খোসা খুলে দেখা গেল আঁটি কাঁচা। রস ও স্বাস পরিপূর্ণ হয়নি। এসব লিচু যে অপরিপক্ব, তা দেখে বোঝার উপায় নেই।

জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে এখনো এক সপ্তাহের বেশি বাকি। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝিতে লিচু পাকে। কিন্তু সময়ের আগেই রাসায়নিক দিয়ে কাঁচা লিচু পাকানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এই লিচু। এসব লিচু কিনে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। নেই প্রশাসনের নজরদারি।

মঙ্গলবার (০৪ মে) কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর, পৌর বাজার, এনএস রোডের ফুটপাতের দোকান ও ফলের বাজার ঘুরে দেখা যায়, সব দোকানে অপরিপক্ক লিচু। জেলার বিভিন্ন স্থানের বাগান থেকে কাঁচা লিচু কিনে কেমিক্যাল ব্যবহার করে পাকিয়ে বিক্রি করছেন। দেখতে পাকা মনে হলেও কাঁচা। অধিক লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা এমন প্রতারণা করছেন বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা।

দেখতে পাকা মনে হলেও লিচু কাঁচা

এসব অপরিপক্ক লিচু কিনে ঠকছেন ক্রেতারা। একাধিক ক্রেতা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার আগের দিন লিচু কিনে পরদিন এসে বিক্রেতার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াচ্ছেন কেউ কেউ।

শহরের মঙ্গলবাড়িয়া এলাকার তানভীর হাসান বলেন, সোমবার বাজার থেকে লিচু কিনেছিলাম। বাসায় গিয়ে লিচুর খোসা খুলে দেখি ভেতরের আঁটি কাঁচা। সবে মাত্র সাদা স্তর পড়তে শুরু করেছে। কেনার সময় বাইরের খোসার রঙ ছিল পাকা লিচুর মতো। অথচ অপরিপক্ব। কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়েছে এসব লিচু।

রাজন আলী বলেন, রোববার ১০০ পিস লিচু ২৮০ টাকায় কিনেছি। কেনার আগে দোকানে লিচুর রঙ দেখে মনে হয়েছে পাকা। দোকানিও তাই বলে বিক্রি করেছেন। কিন্তু বাসায় নিয়ে দেখি কাঁচা। স্বাদ-গন্ধ কিছুই নেই।

জিকু আহমেদ নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ছোট থেকে আমার খুব পছন্দ লিচু। রোজার মাসে পছন্দের এই ফল আমি সোমবার কিনেছিলাম। কিন্তু ইফতারের সময় ওই লিচু মুখে দিতে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড টক ও অপরিপক্ক। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। পরদিন বাজারে গিয়ে লিচু বিক্রেতার সঙ্গে ঝগড়া করেছি। 

কেমিক্যাল ব্যবহারে লিচুর রঙ সুন্দর হয়, ক্রেতারা সহজেই আকৃষ্ট হন

ক্রেতাদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, লিচু বাগানে অনেক গাছ থাকে। সেখানে বিভিন্ন গাছে লিচু ধাপে ধাপে পাকে। কিন্তু এভাবে ধাপে ধাপে পাকা লিচু আনতে তাদের খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে ফল পাকার পর বিক্রি করতে আরও কয়েকদিন রাখার প্রয়োজন হয়। সব ফল একসঙ্গে পাকে না। এগুলো নিয়মিত বাছাই করতেও খরচের প্রয়োজন। তাই বেশি মুনাফার আশায় একসঙ্গে সব লিচু পাকাতে অনেকে রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। ফলে ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ কম হয়। এছাড়া এতে কেমিক্যাল ব্যবহারে রঙ সুন্দর হয়। যাতে ক্রেতারা সহজেই আকৃষ্ট হন। 

হামিদুল ইসলাম মৃধা নামের একজন চাকরিজীবী বলেন, কোথায় ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর, বিএসটিআই ও ভ্রাম্যমাণ আদালত? বাজার বিষযুক্ত ও অপরিপক্ক লিচুতে সয়লাব। তারা বাজারে এসে দেখুক, বাজারে কি লিচু বিক্রি হচ্ছে। এত আগে লিচু পাকছে কীভাবে? এগুলো বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এদের শাস্তি নিশ্চিত করুন।

লিচু ব্যবসায়ী রঞ্জু আহমেদ বলেন, এসব লিচু কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো। আরও ১৫-২০ দিন পর পাকা লিচু বাজারে আসবে। বাজারের সব লিচুই অপরিপক্ক।

অপরিপক্ক ও কেমিক্যাল দেওয়া লিচু বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কাউকে জোর করে দিই না। যারা খেতে চান তারা কেনেন। বাজারে এসব ফল না এলে আমরা বিক্রি করতাম না। আমরা তো কেমিক্যাল দিয়ে লিচু পাকাই না। আমরা কিনে বিক্রি করি।

লিচু পাকা, আঁটি কাঁচা 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো লিচু পাকা শুরু হয়নি। বাজারের অপরিপক্ক লিচুতে যত বেশি রাসায়নিক মেশানো হয়, সে লিচু তত বেশি সতেজ ও পাকা দেখায়। কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো লিচু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শুধু লিচু নয়; যেকোনো খাবারের মাধ্যমে এ কেমিক্যাল শরীরে গেলে ত্বকের ক্যানসার, কোলন ক্যানসার, জরায়ুর ক্যানসার, লিভার ও কিডনির জটিলতাসহ মস্তিষ্কের ক্ষতির মতো মারাত্মক রোগ হতে পারে। তাই এ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শ্যামল কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিচু পাকতে আরও দুই সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। আগামী ২০ মে দিকে বাজারে পরিপক্ক লিচু পাওয়া যাবে। বাজারে বর্তমানে দেশি অপরিপক্ক লিচু পাওয়া যাচ্ছে। এই লিচুর আসল স্বাদ পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে কেবল মুনাফার জন্যই চাষি ও বাগানমালিক অপরিপক্ব লিচু বাজারে তুলছেন।

কুষ্টিয়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক কাজী রকিবুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। লিচুর বাজারেও অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শুধু অভিযান চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। চাহিদা থাকলে জোগান আসবেই। আমাদের উচিত চাহিদা বন্ধ করা। কারণ এখন লিচু কিনতে হবে কেন? পরিপক্ব লিচু আসলে তখন কিনুক সবাই। 

রাজু আহমেদ/এএম